ঢাকা: পাসপোর্ট করতে গিয়ে বিভিন্ন হয়রানি, দালালের উৎপাত ও দীর্ঘসূত্রতার মুখে সাধারণ মানুষ পড়ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। ফাইল ছবি/নিউজবাংলা
পাসপোর্ট করাতে দীর্ঘসূত্রতার সুযোগ নিচ্ছে দালালচক্র। বড় অঙ্কের টাকার বিনিময়ে তারা দ্রুত পাসপোর্ট করিয়ে দিচ্ছে, আরও কিছু জটিলতাও এড়ানো যাচ্ছে দালালের সাহায্যে। ঢাকার আগারগাঁওয়ে পাসপোর্ট অফিস ঘিরে তৎপর দালালচক্রের সদস্যরা।
পাসপোর্ট সেবা সহজ করতে ‘এজেন্ট’ নিয়োগের বিষয়টি পরিকল্পনাতেই আটকে আছে। দালালের উৎপাত বন্ধ এবং সেবাপ্রত্যাশীরা ঘরে বসেই এজেন্টের মাধ্যমে পাসপোর্ট করাতে পারবেন- এমন চিন্তা থেকে বছর কয়েক আগে পরিকল্পনাটির তথ্য জানিয়েছিল পাসপোর্ট অধিদপ্তর। এ বিষয়ে একটি নীতিমালাও তৈরি করা হয়েছে। তবে এরপর আর অগ্রগতি হয়নি।
এমন অবস্থায় আগের মতোই আছে দালালের উৎপাত, পাসপোর্ট করতে গিয়ে বিভিন্ন হয়রানি ও দীর্ঘসূত্রতার মুখে পড়ছেন সাধারণ মানুষ।
গত অক্টোবরে নিজের পাসপোর্ট করতে অনলাইনে আবেদন করেন সংবাদমাধ্যমকর্মী কেরী আশীর্বাদ বিশ্বাস। তিনি জানান, অক্টোবরের ১০ তারিখ আবেদন করলেও তার আঙুলের ছাপ নেয়ার তারিখ দেয়া হয় ডিসেম্বরের ১২ তারিখ।
কেরী আশীর্বাদ বলেন, ‘আমি দুই মাস ধরে অপেক্ষা করছি। ১২ ডিসেম্বর শিডিউল ডেট দিয়েছে। এটা খুবই ঝামেলার।’
এ ধরনের দীর্ঘসূত্রতার সুযোগ নিচ্ছে দালালচক্র। বড় অঙ্কে টাকার বিনিময়ে তারা দ্রুত পাসপোর্ট করিয়ে দিচ্ছে, আরও কিছু জটিলতাও এড়ানো যাচ্ছে দালালের সাহায্যে।
ফ্রিল্যান্স কর্মী অর্নব দেবনাথ বলেন, ‘সম্প্রতি আমি পুরোনো পাসপোর্ট বদলে ই-পাসপোর্টে রিনিউ করেছি৷ একটি এফিডেভিট ও দ্রুত কাজ সারতে দালালকে বাড়তি ৬ হাজার টাকা দিতে হয়েছে। ১৫ দিনেই পাসপোর্ট পেয়ে গেছি।’
পাসপোর্ট অফিস ঘিরে দালালদের দৌরাত্ম্য
ঢাকার আগারগাঁওয়ে পাসপোর্ট অফিসে গিয়ে দেখা যায়, ভবনের সামনেই সেবাপ্রত্যাশীদের সঙ্গে দর-কষাকষি করছেন দালালচক্রের সদস্যরা। ভোগান্তি এড়াতে অনেকেই বাধ্য হয়ে তাদের সাহায্য নিচ্ছেন।
অফিসের সামনের রাস্তা দিয়ে কেউ হেঁটে গেলেই তাকে ডাকাডাকি করছেন যুবক ও মধ্যবয়সী কিছু ব্যক্তি। অন্যদিকে ভবন থেকে খানিকটা সামনে গিয়ে দেখা যায় ছাতা মেলে দালালচক্রের ৩০ জনের বেশি সদস্য ল্যাপটপ খুলে বসে আছেন।
তারা মূলত সেবাপ্রত্যাশীদের অনলাইন আবেদন ফরম পূরণ করে দেন। তাদের কাছে নিয়ে যেতে চক্রের অন্য সদস্যরা তৎপর থাকেন পাসপোর্ট অফিসের গেটের আশপাশে। রাস্তার বিপরীত পাশের একটি মার্কেটও রয়েছে দালালদের অবস্থান। তারা ফরম পূরণ থেকে শুরু করে পাসপোর্ট দ্রুত করিয়ে দেয়ার প্রলোভন দেখাচ্ছেন সাধারণ মানুষকে।
মামুন হোসেন নামে দালালচক্রের এক সদস্যের সঙ্গে পরিচয় গোপন করে কথা বলেন প্রতিবেদক। তিনি বলেন, ‘একটা ফরম পূরণ করবেন। এরপর ফিঙ্গার প্রিন্টের শিডিউল ডেট পাবেন। সরকারি খরচ ৮ হাজার ৫০ টাকা ব্যাংকে জমা দিতে হবে। তবে আমি সব এক দিনেই করিয়ে দেব। এ জন্য বাড়তি ৪ হাজার টাকা দিতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘ফরম পূরণের পর আজকেই ফিঙ্গার নেয়ে নেবে। স্লিপ দিয়া দেব আজকেই। এক সপ্তাহ পর বই (পাসপোর্ট) পেয়ে যাবেন।’
কোনো ঝামেলা হবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কিসের ঝামেলা! আপনার ভোটার আইডি কার্ড তো আছেই। আপনার ঠিকানা আপনি সব কিছু দেবেন। খালি ফরম পূরণ করবেন। আর আমি টাকা দিয়া ভেতরের লোকের মাধ্যমে বই (পাসপোর্ট) বের করে দেব।’
পাসপোর্ট অধিদপ্তরের তথ্যকেন্দ্রের সামনেই পাওয়া যায় দালাল রিমনকে। পরিচয় গোপন করে নিউজবাংলা প্রতিবেদক কথা বলা শুরু করতেই রিমনের এক পরিচিত নারী তাকে সতর্ক করে বলেন, ‘ওই পোলা ওই সাইডে যাইয়া কথা ক। পুলিশ আইয়া ঝামেলা করব।’
রিমন এরপর একটু সামনে এগিয়ে প্রশ্ন করেন, ‘১০ বছরের জন্য আর্জেন্ট করবেন, নাকি নরমাল করবেন?’
স্বাভাবিক সময়সীমার কথা জানানোর পর তিনি বলেন, ‘তাইলে ৫ হাজার ৭৫০ টাকা জমা দিয়া, ছবি তুইলা, ফিঙ্গার নিয়া আজকেই রিসিট কাটাইয়া দিমু। আজকেই সব কইরা দিমু।’
ঢাকায় পুলিশ ভেরিফিকেশনের রিপোর্টের প্রসঙ্গ টেনে এই যুবক বলেন, ‘ওইটা কি আপনি কইরা নিবেন? নাকি আমি কইর দেব?’
সব কাজ করে দিলে কত খরচ হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘পুরা প্যাকেজেই বই (পাসপোর্ট) বানাইয়া দিমু, খালি স্থায়ী ঠিকানার রিপোর্টটা আপনার কইরা লইতে হইব। বাপ-মায়ের আইডি কার্ডের ফটোকপি দেবেন। নিজের আইডি কার্ডের ফটোকপি দেবেন। ঢাকায় বিদ্যুৎ বিলের ফটোকপি স্ট্যাপলার মাইরা দেশে পাঠাইয়া দেবেন। এক হাজার টাকা দিয়া দিবেন পুলিশরে। রিপোর্ট এন্ট্রি হইয়া গেলে ২৫ দিনের মধ্যে বই পাইয়া যাইবেন।
‘১০ বছরের পাসপোর্টের জন্য ফরম পূরণ, ব্যাংক জমাসহ ইনটোটাল ১৩ হাজার টাকা খরচা হইব। ফরমফিলাপ, ছবি তুইলা, ফিঙ্গার দিয়া আজকের মধ্যে যাইবেন গা। সব আজকেই হইয়া যাইব।’
তিনি জানান, পাসপোর্ট অফিসের ভেতরে কিছু কর্মকর্তা ও কর্মী আছেন। তাদের মাধ্যমেই তিনি কাজগুলো করাবেন।
কিছু কমে কাজ করা যাবে কি না- এমন প্রশ্নে রিমন বলেন, ‘এর কমে হইব না। ৫ হাজার ৭৫০ টাকা হইল সরকারি ব্যাংক জমা। সার্ভিস চার্জ নিব ব্যাংকে ২০০ টাকা। ফরম পূরণ নিব ২০০ টাকা৷ ফাইল জমা করতে লাগবে ৩ হাজার টাকা। ঢাকায় পুলিশ রিপোর্ট করাইতে লাগব ১ হাজার টাকা।’
দালালচক্রের সদস্যরা পাসপোর্টের জন্য সরকারি খরচের বিভিন্ন হিসাব দিলেও পাসপোর্টভেদে এই হার নির্ধারিত।
পাঁচ বছরের জন্য ৪৮ পৃষ্ঠার নিয়মিত পাসপোর্ট বাবদ ব্যাংকে জমা দিতে হয় ৪ হাজার ২২৫ টাকা। ১০ বছরের জন্য দিতে হয় ৫ হাজার ৭৫০ টাকা, যা ২১ দিনে পাওয়া সম্ভব বলে জানানো হয়েছে পাসপোর্ট অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে।
জরুরি ক্যাটাগরিতে পাঁচ বছরের জন্য ৪৮ পৃষ্ঠার পাসপোর্ট বাবদ জমা দিতে হয় ৬ হাজার ৩২৫ টাকা। ১০ বছরের জন্য পরিশোধ করতে হয় ৮ হাজার ৫০ টাকা, যা ১০ দিনের মধ্যে পাওয়ার কথা।
অন্যদিকে অতীব জরুরি ক্যাটাগরিতে পাঁচ বছরের জন্য ৪৮ পৃষ্ঠার পাসপোর্টের জন্য পরিশোধ করতে হবে ৮ হাজার ৬২৫ টাকা। ১০ বছরের জন্য সেবাপ্রত্যাশীকে দিতে হয় ১০ হাজার ৩৫০ টাকা, দুই দিনে এই সেবা পাওয়া যাবে।
পাঁচ বছরের জন্য ৬৪ পৃষ্ঠার নিয়মিত পাসপোর্ট বাবদ জমা দিতে হয় ৬ হাজার ৩২৫ টাকা। ১০ বছরের জন্য পরিশোধ করতে হয় ৮ হাজার ৫০ টাকা, যা মেলার কথা ২১ দিনের মধ্যে। জরুরি ক্যাটাগরিতে পাঁচ বছরের জন্য ৬৪ পৃষ্ঠার পাসপোর্ট বাবদ জমা দিতে হয় ৮ হাজার ৬২৫ টাকা। ১০ বছরের জন্য পরিশোধ করতে হয় ১০ হাজার ৩৫০ টাকা, যা ১০ দিনের মধ্যে পাওয়ার কথা।
অতীব জরুরি ক্যাটাগরিতে পাঁচ বছরের জন্য ৬৪ পৃষ্ঠার পাসপোর্টের জন্য জমা দিতে হবে ১২ হাজার ৭৫ টাকা। ১০ বছরের জন্য সেবাপ্রত্যাশীকে পরিশোধ করতে হয় ১৩ হাজার ৮০০ টাকা।
এ ছাড়া ই-পাসপোর্ট আবেদন ফির সঙ্গে ১৫ শতাংশ ভ্যাট সংযোজিত হবে।
কর্তৃপক্ষ যা বলছে
ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের পরিচালক (বিভাগীয় পাসপোর্ট ও ভিসা অফিস, ঢাকা) মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ফিঙ্গারপ্রিন্ট প্রক্রিয়া অটোমেটেড সিস্টেম। এখানে দালালদের টাকা দেয়ার সুযোগ নেই।’
দালালদের দৌরাত্ম্য এর পরও কীভাবে চলছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কিছু দিন আগে অফিসের সামনের সব কম্পিউটারের দোকান তুলে দিয়েছি৷ তবে ফুটপাত থেকে ওরা সরছে না। ওরা বলে, এটা পাসপোর্ট অফিসের জায়গা না।’
তিনি বিষয়টি র্যাবকে জানানোর পরামর্শ দিয়ে বলেন, ‘তারা (দালাল) কেন ফুটপাতে দোকান নিয়ে বসছে, সেটি আপনি র্যাবকে জানান।’
আব্দুল্লাহ আল মামুন দাবি করেন, এক দিনে ফিঙ্গারপ্রিন্টসহ সব কাজ সেরে সাত দিনের মধ্যে পাসপোর্ট দেয়ার যে দাবি দালালরা করছেন, তা ভিত্তিহীন।
তিনি বলেন, ‘দালালরা তো কত কিছুই বলে। সব সত্য হয় নাকি। সুপার এক্সপ্রেসে এ রকমটা সম্ভব, বাকিগুলোতে এটা সম্ভব নয়।’
২০১৬ সালের ৪ জানুয়ারি তখনকার বহিরাগমন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মাসুদ রেজওয়ান সাংবাদিকদের কাছে ‘পাসপোর্ট এজেন্ট’ নিয়োগের পরিকল্পনা জানান।
সে সময় এ-সংক্রান্ত একটি খসড়া নীতিমালা করে অনুমোদনের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠায় বহিরাগমন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তর। এজেন্টদের বাছাইয়ে অধিদপ্তরের একজন অতিরিক্ত মহাপরিচালককে প্রধান করে কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়।
চলতি বছরের গত ১৬ এপ্রিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা ও সেবা বিভাগের তখনকার সচিব মোকাব্বির হোসেন বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে একটি নীতিমালা তৈরি করা হয়েছে। সেটি যাচাই-বাছাইয়ের কাজ চলছে। এ বছরের শেষ নাগাদ প্রক্রিয়াটি বাস্তবায়ন সম্ভব হবে বলে আমি আশাবাদী।
মোকাব্বির হোসেন তখন বলেন, ‘এখানে অনেক বিষয় আছে। এজেন্টের ক্যাটাগরি, নীতিমালা এগুলো যাচাই-বাছাই চলছে, কী ক্যাটাগরিতে দেয়া হবে, কারণ হুট করে দিলে পরে কোনো বড় ধরনের সমস্যা ক্রিয়েট হলে তো হবে না।’
তবে বছর শেষে বিষয়টি নিয়ে অগ্রগতির আর কোনো তথ্য মেলেনি।
‘পাসপোর্ট এজেন্ট নিয়োগের বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ‘এখনও এগুলো কিছুই হয়নি। পরিকল্পনার মধ্যেই আছে।’
পাসপোর্ট অফিসে দালালদের তৎপরতার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, ‘তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।