কক্সবাজার: বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তবর্তী নাফ নদী এখন জেলেদের জন্য ভয়ংকর এক জলপথে পরিণত হয়েছে। মিয়ানমারের সশস্ত্র বিদ্রোহী সংগঠন আরাকান আর্মি প্রতিনিয়ত বাংলাদেশি জেলেদের অপহরণ করছে। গত ২৩ দিনে তারা ৬৩ জন জেলে ও ১০টি ট্রলার অপহরণ করেছে বলে জানিয়েছে ট্রলার মালিক সমিতি।
সম্প্রতি, বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড আরাকান আর্মির কবল থেকে রক্ষার চেষ্টায় ১২২ জন জেলেকে আটক করেছে, যাদের মধ্যে ২৯ জন বাংলাদেশি ও ৯৩ জন রোহিঙ্গা নাগরিক। তাদের বিরুদ্ধে সীমান্ত অতিক্রম করে মিয়ানমারের জলসীমায় মাছ ধরার অভিযোগ রয়েছে।
এদিকে, গত চার দিনেই ৪৪ জন জেলেকে ধরে নিয়ে গেছে আরাকান আর্মি। সূত্র জানায়, রাখাইনে পাচারকালে কোস্টগার্ড ট্রলারভর্তি আলু জব্দ করলে ক্ষুব্ধ হয়ে প্রতিশোধ নিতে এই অপহরণের ঘটনা ঘটায় তারা।
বিশেষ করে শাহপরীর দ্বীপের নাইক্ষ্যংদিয়া সংলগ্ন জলসীমায় এই অপহরণ বেশি ঘটছে। টেকনাফ থেকে মাছ শিকার শেষে ফেরার সময় ওত পেতে থাকা আরাকান আর্মির সদস্যরা স্পিডবোটে এসে অস্ত্রের মুখে জেলেদের তুলে নিয়ে যাচ্ছে।
ট্রলার মালিক সমিতির তথ্য বলছে— গত ৫ আগস্ট: ১ নৌকা, ২ জেলে; ১২ আগস্ট: ১ ট্রলার, ৫ জেলে; ২৩ আগস্ট: ১ ট্রলার, ১২ জেলে; ২৪ আগস্ট: ২ ট্রলার, ১৪ জেলে; ২৫ আগস্ট: ১ ট্রলার, ৭ জেলে ও ২৬ আগস্ট: ২ ট্রলার, ১১ জেলেকে অপহরণ করে আরাকান আর্মির সদস্যরা।
এই হিসেবে গত ২২ দিনে মোট ৫১ জন জেলে ও ৮টি ট্রলার ধরে নিয়ে গেছে বিদ্রোহীরা, যাদের এখনও কোনো খোঁজ মেলেনি।
বিগত এক বছরে চিত্র আরও ভয়াবহ: ২০২৪ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৫ সালের ২৬ আগস্ট পর্যন্ত সময়ে আরাকান আর্মি প্রায় ২৫০ জন বাংলাদেশি জেলেকে অপহরণ করেছে। এর মধ্যে বিজিবির প্রচেষ্টায় ১৮৯ জন জেলে ও ২৭টি ট্রলার উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে।
টেকনাফ পৌরসভার কায়ুকখালীয়া ঘাট ট্রলার মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম জানান, সর্বশেষ ২৬ আগস্ট, মাছ ধরে ফেরার পথে শাহপরীর দ্বীপ সংলগ্ন এলাকায় ২টি ট্রলারসহ ১১ জন জেলেকে ধরে নিয়ে যায় আরাকান আর্মি। এরপর থেকে তাদের সঙ্গে আর কোনো যোগাযোগ নেই।
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ এহসান উদ্দিন বলেন, “বিষয়টি আমরা শুনেছি। প্রতিদিনই আরাকান আর্মির দিক থেকে হুমকি থাকছে। ট্রলার মালিক সমিতি জানিয়েছে, গত চারদিনেই ৬টি ট্রলারসহ ৪৪ জন জেলে অপহরণ হয়েছে।”
কোস্টগার্ডের পক্ষ থেকে জানানো হয়, যেসব জেলেকে আটক করা হয়েছে, তাদের যদি না আটক করা হতো, তাহলে আরাকান আর্মির সদস্যরা তাদের অপহরণ করত।
বিজিবি জানায়—বর্তমানে আরাকান আর্মির হেফাজতে ৫১ জন বাংলাদেশি জেলে রয়েছে। তাদের মুক্ত করতে চেষ্টা চলছে। রামু সেক্টরের কমান্ডার কর্নেল মো. মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, “আরাকান আর্মির সঙ্গে সরাসরি কোনো আনুষ্ঠানিক যোগাযোগ নেই, তবে অনানুষ্ঠানিকভাবে চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে যাতে ভবিষ্যতে এমন ঘটনা আর না ঘটে।”
নাফ নদী ও বঙ্গোপসাগরের বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত এখন আর নিরাপদ নয়। প্রতিনিয়ত অপহরণ ও হুমকির মুখে পড়ে জেলেরা আতঙ্কে রয়েছেন। নিরাপত্তা বাহিনীর উপস্থিতি জোরদার ও কূটনৈতিক উদ্যোগ ছাড়া এ পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পাওয়া কঠিন।