ঢাকা: বুয়েটছাত্র ফারদিন নূর পরশের (২৪) মৃত্যুর ঘটনায় আন্দোলন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থীরা। তবে ফারদিনের পরিবার যদি আইনি কোনো পদক্ষেপ নেয় তবে তাদের সহযোগিতা করার কথাও জানিয়েছেন তারা। সেই সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা যদি ফারদিনের মৃত্যু নিয়ে নতুন কোনো তথ্য পায় তবে আবারও কর্মসূচির ঘোষণা করা হবে বলে জানিয়েছেন তারা।
শনিবার (১৭ ডিসেম্বর) বুয়েট ক্যাম্পাসে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে আপাতত আন্দোলন থেকে সরে আসার এই ইঙ্গিত দিয়েছেন ফারদিনের সহপাঠীরা।
গত ৪ নভেম্বর রাতে রাজধানীর রামপুরা এলাকায় বান্ধবী বুশরাকে বাসায় যাওয়ার জন্য এগিয়ে দেন বুয়েট শিক্ষার্থী ফারদিন। এরপর থেকেই নিখোঁজ ছিলেন তিনি। পরে গত ৭ নভেম্বর সন্ধ্যায় নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদী থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় ৯ নভেম্বর রাতে ডিএমপির রামপুরা থানায় ফারদিনের বাবা বাদী হয়ে বুশরাসহ অজ্ঞাত বেশ কয়েকজনের নামে একটি মামলা দায়ের করেন। সেই মামলায় বুশরাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়।
এদিকে, ঘটনার পর বুয়েটছাত্র ফারদিন নূর পরশের ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। ওই ভিডিওতে ৩ নভেম্বর দিবাগত রাত সোয়া ২টার দিকে ফারদিনকে যাত্রাবাড়ীতে লেগুনায় উঠতে দেখা যায়। সিসিটিভির সেই ফুটেজটি ডিবির হাতে আসার পর নতুন মোড় নেয় ফারদিন হত্যাকাণ্ড তদন্তে। সেই সঙ্গে যে লেগুনায় ফারদিনকে উঠতে দেখা যায় তার চালক ও হেলপারকেও নজরদারিতে রাখা হয়। এমনকি মাদক কারবারিদের হাতেও ফারদিন খুন হতে পারেন বলে সে সময় ধারণা করে পুলিশ ও র্যাব।
অন্যদিকে, নারায়ণগঞ্জের ভিক্টোরিয়া জেনারেল হাসপাতালের আরএমও ডা. শেখ ফরহাদ জেলা সিভিল সার্জনের কাছে জমা দেওয়া ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে জানান, ফারদিন নূর পরশের মৃত্যু হয়েছে আঘাতজনিত কারণে, মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের ফলে। তার মাথায় ও বুকের পাঁজরে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। পরে এসব ক্লু নিয়েই কাজ শুরু করে র্যাব ও পুলিশের গোয়েন্দা টিমের সদস্যরা।
পরবর্তীকালে মামলার তদন্তে প্রাপ্ত তথ্যের বরাতে গত বুধবার (১৪ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশিদ হঠাৎ সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করেন। একই সময় ফারদিন হত্যা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়ার কথা জানিয়ে র্যাবের পক্ষ থেকেও সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
পরে ওইদিন সংবাদ সম্মেলনে ডিবি প্রধান হারুন অর রশিদ বলেন, বুয়েটছাত্র ফারদিন নূর পরশ অন্তর্মুখী ছিলেন। সবার সঙ্গে সবকিছু শেয়ার করতে পারতেন না। হতাশা থেকে তিনি আত্মহত্যা করেছেন বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। মৃত্যুর সেই রাতে ফারদিন নারায়ণগঞ্জের চনপাড়ায় যাননি। সর্বশেষ তাকে যাত্রাবাড়ীতে দেখা গেছে। সারারাত এদিক-সেদিক ছোটাছুটি করেছেন তিনি।
এর পরপর রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে একই তথ্য জানায় র্যাব। ওই সময় ফারদিন স্বেচ্ছায় সুলতানা কামাল ব্রিজ থেকে নদীতে ঝাঁপ দিয়েছেন বলে জানান র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন। সেই সঙ্গে তিনি জানান, অধিকতর তথ্য প্রযুক্তির বিশ্লেষণ, সিসিটিভি ফুটেজসহ স্থানীয় বিভিন্ন সূত্রের আলোকে রহস্য উদ্ঘাটনের চেষ্টা করা হয়েছে।
র্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, গত ৪ নভেম্বর বিকাল ৩টায় রাজধানী ডেমরার কোনাপাড়া নিজ বাসা থেকে পরীক্ষার কথা বলে বুয়েটের হলের উদ্দেশে বের হয় ফারদিন। বিকেল আনুমানিক ৫টায় সে সায়েন্স ল্যাব মোড়ে তার পরিচিতার সঙ্গে তিনি দেখা করে। অতঃপর সেখান থেকে নীলক্ষেত ও ধানমন্ডিসহ পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন স্থানে ঘোরাঘুরি করে। পরে সাত মসজিদ রোডে একটি রেস্টুরেন্টে খাবার খেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশে রওয়ানা হয়। একপর্যায়ে রাত আনুমানিক ৮টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিসহ পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন স্থানে ঘোরাঘুরি করে ফারদিন। পরে রিকশাযোগে রামপুরার উদ্দেশে যাত্রা করে।
একপর্যায়ে আনুমানিক রাত পৌনে ১০টার দিকে ফারদিন রামপুরা ব্রিজ এলাকায় রিকশা থেকে নেমে যায় এবং কিছুক্ষণ রামপুরা ব্রিজ এলাকায় ঘোরাফেরা করে। প্রযুক্তিগত বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, পরবর্তীতে সে কেরানীগঞ্জের জিনজিরা, বাবুবাজার ব্রিজ সংলগ্ন এলাকা, পুরান ঢাকার জনসন রোড, গুলিস্তানের পাতাল মার্কেট এলাকায় গমন করে।
Fardinসংবাদ সম্মেলনে কমান্ডার খন্দকার আল মঈন আরও জানান, তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে জানা যায়- ঘটনার দিন রাত দুইটা ২৬ মিনিটে সুলতানা কামাল ব্রিজের তারাবো প্রান্তে ফারদিনের অবস্থান ছিল। পরে রাত ২টা ৩৪ মিনিটে সুলতানা কামাল ব্রিজের প্রায় মাঝখানে আসে ফারদিন। এরপর রাত দুইটা ৩৪ মিনিট ৯ সেকেন্ডে সুলতানা কামাল ব্রিজের রেলিং ক্রস অতিক্রম ছাড়াও রাত দুইটা ৩৪ মিনিট ১৬ সেকেন্ডে সুলতানা কামাল ব্রিজের ওপর থেকে স্বেচ্ছায় নদীতে ঝাঁপ দেয় ফারদিন। ঝাঁপ দেওয়ার পর রাত দুইটা ৩৪ মিনিট ২১ সেকেন্ডে শীতলক্ষ্যা নদীর পানিতে পড়ে ফারদিন। একপর্যায়ে রাত দুইটা ৩৫ মিনিট ৯ সেকেন্ডের দিকে ফারদিনের মোবাইল ফোন বন্ধ হয়ে যায়। আর রাত দুইটা ৫১ মিনিটে ফারদিনের হাতঘড়িতে পানি ঢুকে সেটিও অকার্যকর হয়ে পড়ে।
তবে র্যাব-পুলিশের এমন সব তথ্যে কোনোভাবেই আস্থা রাখতে পারেননি ফারদিনের পরিবারসহ তার সহপাঠীরা। ফারদিনের বাবা তার মৃত্যুকে আত্মহত্যা মানতে রাজি নন। তিনি এ ব্যাপারে আদালতে নারাজি দেবেন বলেও জানিয়েছেন। একই সঙ্গে র্যাব-পুলিশের সংবাদ সম্মেলনের পরদিন ১৫ ডিসেম্বর বুয়েট ক্যাম্পাসে মানববন্ধনের ডাক দেয় ফারদিনের সহপাঠীরা।
ওই সময় আন্দোলনের খবর পাওয়ার পর ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের পক্ষ থেকে বুয়েট শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। পরবর্তীকালে আন্দোলনের আগে ডিবি কার্যালয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন ফারদিনের সহপাঠীরা। পরে প্রায় ৪০ জনের একটি প্রতিনিধি দল ডিবি কার্যালয়ে যায়। সে সময় প্রায় ৩ ঘণ্টা পর তারা ডিবি কার্যালয় থেকে বের হন। পরে ফারদিনের সহপাঠীরা সাংবাদিকদের বলেন, তাদের (ডিবি) এভিডেন্স সবকিছুই প্রাসঙ্গিক মনে হয়েছে। তবে ফারদিনকে ব্রিজের যে পাড়ে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে, তারপর হেঁটে ব্রিজের মাঝখানে গিয়েছে। তারসাথে আর কেউ ছিল কি-না সেটা স্পষ্ট নয়। তবে আমরা ডিবির কার্যকলাপ ও সহযোগিতায় আশ্বস্ত।
এ ঘটনার পর গতকাল শুক্রবার (১৬ ডিসেম্বর) বিকেলে ২১ জনের একটি প্রতিনিধি দল র্যাব সদর দফতরে যায়। একপর্যায়ে প্রায় তিন ঘণ্টা পর সেখান থেকে বেরিয়ে নতুন কিছু তথ্য পাওয়ার কথা জানালেও সাংবাদিকদের তা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন ফারদিনের সহপাঠীরা। ওই সময় তারা জানান, আমরা ডিবি অফিসে গিয়েছিলাম। তবে বেশকিছু তথ্য অজানা রয়ে গিয়েছিল। তাই আমরা র্যাব অফিসে এসেছি। এখানে এসে নতুনকিছু তথ্য পেয়েছি। এছাড়া কিছু তথ্যের ব্যাখ্যাও জেনেছি। এ ব্যাপারে আমরা কথা বলে পরে আপনাদের (সাংবাদিকদের) বিস্তারিত জানাব।
সবশেষ শনিবার সকাল থেকে ক্যাম্পাসে বিষয়টি নিয়ে দফায় দফায় আলোচনা করেন ফারদিনের সহপাঠীসহ অন্যান্য শিক্ষার্থীরা। পরে বিকালে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এ সময় শিক্ষার্থীরা বলেন, আমরা তাদের (র্যাব ও ডিবি) সঙ্গে সাক্ষাৎকারের সময় মূলত পাঁচটি বিষয়ে প্রশ্ন তুলি। তাদের দেখানো এভিডেন্স এবং ডাটার মধ্যে আমাদের করা প্রশ্নগুলোর মোটামুটি সন্তোষজনক উত্তর পেয়েছি। তাদের তদন্ত বা যা যা ডাটা তারা দেখিয়েছেন এতে আর সন্দেহ করার মতো তথ্য আমাদের কাছে নেই।
পরে ফারদিনের মৃত্যু নিয়ে ঘোষিত কর্মসূচি আপাতত স্থগিত করে তারা বলেন, আপাতত ফারদিনের মৃত্যুর বিষয়ে আমাদের আর কোনো কর্মসূচি নেই। ফারদিনের পরিবার যদি যৌক্তিক কোনোকিছু দাবি করেন, আমরা তাদের পাশে দাঁড়াব। তবে আমাদের কাছে এই বিষয়ে আর কোনো সন্দেহ বা প্রশ্ন করার মতো কোনো এলিমেন্ট নেই। ভবিষ্যতে যদি নতুন করে কোনো তথ্য আসে তখন বিষয়টি নিয়ে আবার কথা বলব।