মানবদেহের পূর্ণাঙ্গ জিনবিন্যাস উন্মোচন

আমাদের সময় ডেস্ক
  • আপডেট সময় শনিবার, ২ এপ্রিল, ২০২২

ঢাকা : প্রথমবারের মতো মানুষের জিনের পূর্ণাঙ্গ বিন্যাস উন্মোচন করেছেন বিজ্ঞানীরা। যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার (৩১ মার্চ) ওই বিজ্ঞানী দলের প্রধান ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের হাওয়ার্ড হিউস মেডিকেল ইনস্টিটিউটের ইভান ইচলার যুগান্তকারী এ আবিষ্কারের ঘোষণা দেন।

মানুষের জিনবিন্যাসের ৯২ শতাংশ উন্মোচন হয়েছিল ২০০৩ সালে। বাকি ৮ শতাংশের বিশ্লেষণ করতে প্রায় দুই দশক লাগল। গত বৃহস্পতিবার টেলোমিয়ার টু টেলোমিয়ার (টিটুটি) নামের বিজ্ঞানীদের একটি কনসোর্টিয়াম থেকে পূর্ণাঙ্গ জিনবিন্যাসের ঘোষণা দেওয়া হয়। এ আবিষ্কার মানবদেহের প্রতিটি কোষ কীভাবে গঠিত হয়, স্বতন্ত্র প্রাণিসত্তা হিসেবে মানুষ কীভাবে অস্তিত্বমান কিংবা ‘ভবিষ্যৎ’ কী তার ব্যাখ্যা পাওয়া সহজ হবে। খুলবে রোগের কারণ অনুসন্ধান, রোগপ্রতিরোধ ও নিরাময়ের নতুন দুয়ার।

জীবজগতের বংশগতির সব বৈশিষ্ট্যই এক বা একাধিক জিনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয়। মানুষের জিনের পূর্ণাঙ্গ বিন্যাসকে যুগান্তকারী বলেছেন যুক্তরাজ্যের লিডস বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল অ্যান্ড মলিকুলার জেনেটিকসের বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক কলিন জনসন। তিনি বলেন, ‘এর মাধ্যমে পুরো মানবজীবনের পূর্ণাঙ্গ বিবরণ পাওয়া যাবে। জীবনের প্রতিটি অধ্যায়, পৃষ্ঠা উঠে আসবে।’

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, এর ফলে মানবদেহের প্রতিটি কোষ কীভাবে গঠিত হয়, তা ব্যাখ্যা করা সম্ভব হবে; যা রোগের কারণ অনুসন্ধান, রোগ প্রতিরোধ ও নিরাময়ে নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলবে।যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের ন্যাশনাল হিউম্যান জিনোম রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এনএইচজিআরআই) পরিচালক এরিক গ্রিন বলেছেন, ‘মানুষের জিনের পূর্ণাঙ্গ বিন্যাস করাটা একটি অবিশ্বাস্য বৈজ্ঞানিক অর্জন।

গ্রিন বলেন, ‘এটি প্রথমবারের মতো আমাদের ডিএনএ নকশার পূর্ণাঙ্গ চিত্র দেবে। এই মৌলিক তথ্য মানুষের জিনের সব কার্যকরী সূক্ষ্ম বিষয়গুলো বোঝার জন্য চলমান প্রচেষ্টাগুলোকে আরও গতিশীল করবে। এর ফলে মানুষের অনেক রোগের জিনগত বিশ্লেষণ ত্বরান্বিত হবে।’

টিটুটির গবেষক অ্যাডাম ফিলিপ্পি বলেন, ‘ভবিষ্যতে কারও জিনোম সিকোয়েন্স করা হলে তাঁর ডিএনএর সব রূপ আমরা শনাক্ত করতে পারব, যা স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে আরও উন্নত দিকনির্দেশনা দিতে সক্ষম হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘পূর্ণাঙ্গ মানব জিনজিন্যাস করা মানে নতুন আরেকটি চশমা যুক্ত করা। আমরা এখন আরও পরিষ্কারভাবে সবকিছু দেখতে পাব।’

মানবদেহের প্রথম জিনোম সিকোয়েন্সিং করতে সময় লেগেছিল ১৩ বছর এবং ব্যয় হয়েছিল ২৭০ কোটি ডলার। তবে এখন প্রযুক্তি উন্নত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ডিএনএ বিশ্লেষণের খরচ অনেক কমে গেছে। মানুষের জিনবিন্যাসের তথ্য মজুদ রাখার জন্য সারা বিশ্বে এখন গড়ে তোলা হচ্ছে ‘বায়োব্যাংক’। জিনোমিক্স এবং রোগতত্ত্বকে ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্রে নতুন এক গবেষণা প্রকল্প চলছে। এর আওতায় ড. হিনডর্ফ এবং তার সহযোগীরা বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর প্রায় ৫০ হাজার ডিএনএ তথ্য সংগ্রহ করেন। এ থেকে তারা রক্তচাপ, টাইপ-টু ডায়াবেটিস, ধূমপান এবং জটিল কিডনি রোগের সঙ্গে সম্পর্কিত ২৭টি নতুন ধরনের জিনগত সমস্যা আবিষ্কার করেছেন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বর্ণনা অনুযায়ী, প্রতিটি জীবন্ত প্রাণীর বংশাণুর বা বংশগতির মৌলিক আণবিক একক হচ্ছে জিন। সন্তান বা উত্তরসূরি পিতা-মাতার কাছ থেকেই একটি করে জিন পায়। ডিঅক্সিরাইবো নিউক্লিক এসিড বা ডিএনএর নির্দিষ্ট স্থানে এই জিন অবস্থান করে; যা জীবজগতের বংশগতির ধারক ও বাহক। জীবের বৈশিষ্ট্য নির্ধারিত হয় এর মাধ্যমেই। আর জীবের বৃদ্ধি, প্রজনন, পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়াসহ যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনা করে জিনোম। তবে জিনোমের পুরোটাই জিন নয়। জিন বলতে জিনোমের সেই অংশকে বোঝানো হয়, যা নির্দিষ্ট কোনো প্রোটিন তৈরির কোড ধারণ করে। মানুষের শরীরে তিন বিলিয়ন জোড়া বেইসের মধ্যে জিন রয়েছে মাত্র ২০ হাজারের মতো। এ জিনগুলো সম্মিলিতভাবে মানুষের সব বৈশিষ্ট্য ধারণ করে।

এনএইচজিআরআইর তথ্য অনুযায়ী, কোনো জীবের শরীরের বিষয় জানতে, তার ত্রুটি শনাক্ত বা দূর করতে হলে আগে তার জিন সম্পর্কে জানতে হবে। আর জিন সম্পর্কে জানতে বা শনাক্ত করার জন্য প্রথমে তার জিনোম সিকোয়েন্সিং বা বিন্যাস করতে হবে। জিনোম সিকোয়েন্সিং করার অর্থ হলো শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ডিএনএ অণুর ভেতর বেইসগুলো কীভাবে আছে তা বের করা। এরপর বিজ্ঞানীরা সেই জিনোমে বা ডিএনএতে পরিবর্তন এনে ক্ষতিকর উপাদান বা ঝুঁকি হ্রাস করার চেষ্টা করতে পারেন, যাকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় জিন এডিটিং।

এই গবেষণায় দুই হাজার নতুন জিন শনাক্ত করেছেন বিজ্ঞানীরা। এসব জিনের বেশির ভাগই নিষ্ক্রিয়। তবে ১১৫টি জিন সক্রিয় বলে ধারণা করা হচ্ছে। এর বাইরে গবেষকেরা ২০ লাখের বেশি অতিরিক্ত জিনগত রূপান্তর শনাক্ত করেছেন, যার মধ্যে ৬২২টি বর্তমানে চিকিৎসাবিজ্ঞান সংশ্লিষ্ট।

টেলোমিয়ার টু টেলোমিয়ার (টিটুটি) কনসোর্টিয়ামের নামকরণ করা হয়েছিল ক্রোমোসোমের প্রান্তের দিকে অবস্থিত একটি কাঠামোর নাম অনুসারে। অধিকাংশ জীবিত কোষের নিউক্লিয়াসে সুতার মতো কাঠামোর এই বস্তুটি জিনগত তথ্য বহন করতে পারে।

এই পোস্ট টি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরও সংবাদ
© All rights reserved © 2023 amadersomoy.net
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com