শিরোনাম
দেশের প্রথম ভ্যাকসিন ও এন্টিভেনাম উৎপাদন প্লান্ট হচ্ছে মুন্সিগঞ্জে, ব্যয় ৩১২৪ কোটি টাকা বাংলাদেশের শুল্কমুক্ত আমদানি ঘোষণায় ভারতে চালের দাম বৃদ্ধি ‘রুকন না হলে চাকরি থাকবে না’, এটি সম্পূর্ণ মিথ্যা: ইফার ডিজি রাজধানীতে নির্মাণাধীন ভবনে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে ৩ জনের মৃত্যু কক্সবাজার সফর: এনসিপির ৫ নেতাকে দেয়া শোকজ প্রত্যাহার নেপালকে অনায়াসে হারাল বাংলাদেশ সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সকল সহযোগিতায় পাশে থাকার আশ্বাস দিলেন সেনাপ্রধান ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ডিজি বলেছেন রুকন না হলে চাকরি থাকবে না: রিজভী লন্ডনে গিয়ে সিজদা দিয়ে এসেছেন প্রধান উপদেষ্টা: হাসনাত রাশিয়ায় গানপাউডার কারখানায় বিস্ফোরণে ১১ জন নিহত, আহত শতাধিক

জুলাই সনদের চূড়ান্ত খসড়া রাজনৈতিক দলগুলোর হাতে

আমাদের সময় ডেস্ক
  • আপডেট সময় শনিবার, ১৬ আগস্ট, ২০২৫

ঢাকা : গত বছরের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার তীব্র গণঅভ্যুত্থানের মুখে পতন ঘটে ফ্যাসিস্ট হাসিনার দেড় দশকের স্বৈরশাসনের। ওই বছরের ৫ আগস্ট স্বৈরাচার শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে গেলে তার জুলুম-নিপীড়নের শাসনের অবসান ঘটে। এর তিন দিন পর ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে। গণঅভ্যুত্থানের অংশজনের দাবির প্রেক্ষিতে জুলাই সনদ প্রণয়ন করে সরকার। অবশেষে সরকার সেই জুলাই সনদের চূড়ান্ত খসড়া প্রণয়ন করে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠিয়েছে।

শনিবার সন্ধ্যায় প্রকাশ পাওয়া জুলাই সনদের ভূমিকায় বলা হয়েছে, সুদীর্ঘ গণতান্ত্রিক সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে সংঘটিত ছাত্র-শ্রমিক-জনতার সফল গণঅভ্যুত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে একটি গণতান্ত্রিক ও মানবিক রাষ্ট্র পুনর্গঠনের ঐতিহাসিক সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এই সন্ধিক্ষণে আমরা নিম্নস্বাক্ষরকারীগণ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশন এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, জোট ও শক্তিসমূহ পারস্পরিক ও সম্মিলিত আলোচনার মাধ্যমে রাষ্ট্রের সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন ও দুর্নীতি দমন বিষয়ে সংস্কারের লক্ষ্যে নিম্নলিখিত বিষয়ে ঐকমত্যে উপনীত হয়েছি।

এরপর ধারাবাহিকভাবে সনদে স্থান পাওয়া বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়-

১। পটভূমি
প্রায় দু’শো বছরের বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে নিপীড়িত জনগণের দীর্ঘ লড়াইয়ের ধারাবাহিকতায় ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান নামক একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয় এবং পূর্ব বাংলা তার অন্তর্ভুক্ত হয়। কিন্তু পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠির স্বৈরশাসন, শোষণ, বঞ্চনা ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে এক রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যূদয় ঘটে। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে বর্ণিত সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামজিক সুবিচারের নীতিকে ধারণ করে সংঘটিত মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা গঠনের আকাঙ্ক্ষা বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে তৈরি হয়েছিল, দীর্ঘ ৫৩ বছরেও তা অর্জন করা যায়নি। কারণ, শাসন ব্যবস্থায় গণতান্ত্রিক পদ্ধতি ও সংস্কৃতি বিকাশের ধারা বারবার হোঁচট খেয়েছে। বিগত পাঁচ দশকে রাষ্ট্রের সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে একদিকে যেমন টেকসই ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠা করা যায়নি, অপরদিকে তেমনি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো নামেমাত্র থাকলেও তা অত্যন্ত ন্যুব্জ ও দুর্বলভাবে কাজ করেছে। বস্তুতপক্ষে, রাষ্ট্রকাঠামোতে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের সুরক্ষা নিশ্চিতের লক্ষ্যে দলীয় প্রভাবের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে অকার্যকরী ও বিচারহীনতার সহায়ক হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছিল।

বিগত ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন একটি দলীয় সরকার রাষ্ট্রপরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করে ক্রমান্বয়ে অবশিষ্ট গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে জলাঞ্জলি দিয়ে অগণতান্ত্রিক ও ফ্যাসিবাদী চরিত্র ধারণ করতে থাকে। তারা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও সমালোচকদের গণতান্ত্রিক ও মানবাধিকার হরণ, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় গুম, খুন, নিপীড়ন-নির্যাতন, মামলা, হামলার মাধ্যমে একটি নৈরাজ্যকর ও বিভীষিকাময় ত্রাস ও ভীতির রাজত্ব কায়েম করে। ২০০৯ সালের পিলখানায় বিডিআর হত্যাকান্ড ও ২০১৩ সালে মতিঝিলের শাপলা চত্ত্বরের হত্যাকান্ড অন্যতম উদাহরণ। ২০০৯ সাল থেকে ২০২৪ পর্যন্ত সমগ্র রাষ্ট্রযন্ত্রকে স্বৈরতান্ত্রিকভাবে বিশেষ ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর বন্দনার জন্য নিবেদিত রাখা হয়। দেড় দশকে স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকার জনস্বার্থের বিরুদ্ধে ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার উদ্দেশ্যে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে সংবিধানের বিকৃতি সাধন, বিভিন্ন নিবর্তনমূলক আইন প্রণয়ন, নির্বাচনি ব্যবস্থাকে ধ্বংস, বিচার বিভাগ ও জনপ্রশাসনকে দলীয়করণ এবং দুর্নীতির মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুণ্ঠনের ব্যবস্থা কায়েম করে।

এই পটভূমিকায় রাজনৈতিক দলগুলোর ধারাবাহিক গণতান্ত্রিক আন্দোলন এবং পরবর্তীতে শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে ২০১৮ সালে সরকারি চাকরিতে কোটা ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন, নিরাপদ সড়ক আন্দোলন এবং অবশেষে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের এক দফা আন্দোলনে বিপুল ছাত্র-শ্রমিক-নারী-পেশাজীবী তথা সকল স্তরের জনতার অংশগ্রহণের ফলে এক অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। এতে শাসকগোষ্ঠীর প্রতিহিংসার শিকার হয়ে শিশু ও নারীসহ এক হাজার চারশোর বেশি নিরস্ত্র নাগরিক নিহত এবং বিশ হাজারের বেশি মানুষ আহত হয়। তাদের আত্মাহুতি ও ত্যাগের বিনিময়ে এবং জনগণের সম্মিলিত শক্তি ও প্রতিরোধের কাছে স্বৈরাচারী শাসক ও তার দোসররা পরাজিত হয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।

এমতাবস্থায়, জনগণের মননে রাষ্ট্র-কাঠামো পুনর্গঠনের এক প্রবল অভিপ্রায় সৃষ্টি হয়েছে। রাষ্ট্র সংস্কার, বিশেষ করে সংবিধানের মৌলিক সংস্কার, ধ্বসে পড়া নির্বাচনি ব্যবস্থার পুনর্গঠন, গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আইন ও বিধি-বিধানের সংস্কার, স্বাধীন বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠা এবং সুশাসিত জবাবদিহিমূলক ও দুর্নীতিমুক্ত সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার যে ঐতিহাসিক সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, তার সদ্ব্যবহার করা আমাদের সকলের নৈতিক দায়িত্ব।

২। সংস্কার কমিশন গঠন
বিদ্যমান সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুসারে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক প্রেরিত প্রশ্নে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের মতামতের ভিত্তিতে ২০২৪ সালের ৮ আগস্ট অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে অর্ন্তবর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে রাষ্ট্র ব্যবস্থার সংস্কারের বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তারই ধারাবাহিকতায় ৭ অক্টোবর ২০২৪ তারিখে সরকার প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠন করে। কমিশনগুলো হচ্ছে—সংবিধান সংস্কার কমিশন, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন, পুলিশ সংস্কার কমিশন ও দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশন। কমিশনগুলো ৩১ জানুয়ারি ২০২৫ তারিখের মধ্যে তাদের সুপারিশসহ প্রতিবেদন দাখিল করে।

৩। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন
জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে সার্বিক সংস্কার প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নেয়ার জন্য অর্ন্তবর্তীকালীন সরকার ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ তারিখে প্রধান উপদেষ্টাকে সভাপতি, সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধানকে সহ-সভাপতি এবং নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন, পুলিশ সংস্কার কমিশন ও দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশনের প্রধানদের সদস্য করে একটি জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করে। পরবর্তীতে উক্ত কমিশন কিছুটা পুনর্গঠন করা হয়। কমিশনের দায়িত্ব ছিল—আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন, পুলিশ ও দুর্নীতি দমন বিষয়ে সংস্কারের জন্য গঠিত কমিশনগুলোর সুপারিশ বিবেচনা ও গ্রহণের লক্ষ্যে জাতীয় ঐকমত্য গঠনের জন্য রাজনৈতিক দল ও শক্তিসমূহের সঙ্গে আলোচনা করা এবং এ মর্মে পদক্ষেপ সুপারিশ করা। কমিশনের মেয়াদ ছিল কার্যক্রম শুরুর তারিখ থেকে ছয় মাস। কমিশন তার দায়িত্ববোধ ও সুপারিশের অংশ হিসেবে ঐকমত্যের মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সংবলিত ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ প্রণয়নের সিদ্ধান্ত নেয়।

৪। কমিশনের কার্যক্রম
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে তার কাজ শুরু করে। ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে ছয়টি কমিশনের প্রতিবেদনের ছাপানো অনুলিপি সব রাজনৈতিক দলের কাছে প্রেরণ করা হয়। এরপর ৫ মার্চ” ২০২৫ তারিখে পুলিশ সংস্কার কমিশন ব্যতীত অপর পাঁচটি কমিশনের প্রতিবেদনের গুরুত্বপূর্ণ ১৬৬টি সুপারিশ স্প্রেডশিট আকারে ৩৮টি রাজনৈতিক দল ও জোটের কাছে মতামতের জন্য পাঠানো হয়। এর মধ্যে সংবিধান সংস্কার বিষয়ক ৭০টি, নির্বাচন সংস্কার বিষয়ক ২৭টি, বিচার বিভাগ সংক্রান্ত ২৩টি, জনপ্রশাসন সংক্রান্ত ২৬টি ও দুর্নীতি দমন বিষয়ক ২৭টি সুপারিশ ছিল। পুলিশ সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলো সরাসরি প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে বাস্তবায়নযোগ্য হওয়ায় সেগুলো স্প্রেডশিটে রাখা হয়নি। অপরদিকে, সংবিধান সংস্কার কমিশন ছাড়া অন্য পাঁচটি কমিশনের দ্রুত বাস্তবায়নযোগ্য সুপারিশগুলোর তালিকা সরকারের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

মোট ৩৫টি রাজনৈতিক দল ও জোট তাদের মতামত কমিশনের কাছে প্রেরণ করে, অনেকে বিস্তারিত ব্যাখ্যা বিশ্লেষণও প্রদান করে। মতামত গ্রহণের পাশাপাশি প্রথম পর্যায়ে ২০ মার্চ থেকে ১৯ মে ২০২৫ পর্যন্ত ৩২টি দল ও জোটের সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের মোট ৪৭টি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনা ফলপ্রসূ করার লক্ষ্যে কিছু দলের সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক হয়। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রথম পর্যায়ের আলোচনা শেষ করে কমিশন অগ্রাধিকার ও গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনায় মোট ২০টি বিষয় নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে দ্বিতীয় দফা আলোচনায় মিলিত হয়। এই প্রক্রিয়ার ফলাফল স্বরূপ নিম্নলিখিত ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ সর্বসম্মতভাবে প্রণীত হয়।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশন এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও জোটের সঙ্গে পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে, আমরা অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দল ও জোটের প্রতিনিধিরা স্ব-স্ব দলেরপক্ষ থেকে বিদ্যমান শাসন ব্যবস্থা তথা সংবিধান, বিচার ব্যবস্থা, নির্বাচন ব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, পুলিশি ব্যবস্থা ও দুর্নীতি দমন বিষয়ে নিম্নলিখিত কাঠামোগত, আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তনের ব্যাপারে ঐকমত্যে উপনীত হয়েছি এবং এইসব বিষয়সমূহকে এই জাতীয় সনদে সন্নিবেশিত করতে সম্মত হয়েছি। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণঅভ্যুত্থানের বীর শহীদ ও আহতদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা প্রকাশ এবং উক্ত গণঅভ্যুত্থানে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণকারীদের প্রতি কৃতজ্ঞতার স্মারক হিসেবে আমরা এই সনদকে ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ হিসেবে ঘোষণা করছি।

৫। ঐকমত্যে উপনীত হওয়ার বিষয়সমূহঃ

রাষ্ট্রভাষা, নাগরিকত্ব ও সংবিধান
১। ভাষা : প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্র ভাষা হবে ‘বাংলা’। সংবিধানে বাংলাদেশে নাগরিকদের মাতৃভাষা হিসেবে ব্যবহৃত অন্যান্য সকল ভাষাকে দেশের প্রচলিত ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা হবে। [৩০টি দল ও জোট একমত]

২। বাংলাদেশের নাগরিকদের পরিচয় : বিদ্যমান সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৬(২) এ বর্ণিত ‘বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসাবে বাঙালী এবং নাগরিকগণ বাংলাদেশী বলিয়া পরিচিত হইবেন’ বিধানটি নিম্নোক্তভাবে প্রতিস্থাপন করা হবে: “বাংলাদেশের নাগরিকগণ ‘বাংলাদেশি’ বলিয়া পরচিত হইবেন।” [৩১টি দল ও জোট একমত]

৩। সংবিধান সংশোধন : সংবিধান সংশোধনের জন্য সংসদের উভয় কক্ষের (নিম্নকক্ষ ও উচ্চকক্ষ) দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থন প্রয়োজন হইবে; তবে প্রস্তাবনাসহ সুনির্দিষ্ট কতগুলো অনুচ্ছেদ যেমন ৮, ৪৮, ৫৬, ১৪২ এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা,(যেটি ৫৮খ, ৫৮গ, ৫৮ঘ, ৫৮ঙ অনুচ্ছেদ হিসেবে সংবিধানে যুক্ত হবে তা) সংশোধনের ক্ষেত্রে গণভোটের প্রয়োজন হবে। [৩০টি দল ও জোট একমত]

৪। সংবিধান বিলুপ্তি ও স্থগিতকরণ ইত্যাদির অপরাধ : সংবিধান বিষয়ক অপরাধ ও সংবিধান সংশোধনের সীমাবদ্ধতা বিষয়ক বিদ্যমান সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭ক এবং ৭খ বিলুপ্ত করা হবে। [২৮টি দল ও জোট একমত]

৫। ক্রান্তিকালীন ও অস্থায়ী বিধানাবলি : সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৫০(২) বিলুপ্ত করা এবং এ সংশ্লিষ্ট ৫ম, ৬ষ্ঠ এবং ৭ম তফসিল সংবিধানে রাখা হবে না। [২৩টি দল ও জোট একমত]

৬। জরুরি অবস্থা ঘোষণা : (১) বিদ্যমান সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৪১ক সংশোধনের সময় ‘অভ্যন্তরীণ গোলযোগের’ শব্দগুলোর পরিবর্তে ‘রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতার প্রতি হুমকি বা মহামারি বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ’ শব্দগুলো প্রতিস্থাপিত হবে। (২) জরুরি অবস্থা ঘোষণার জন্য প্রধানমন্ত্রীর প্রতিস্বাক্ষরের পরিবর্তে মন্ত্রিসভার অনুমোদনের বিধান যুক্ত করা হবে। জরুরি অবস্থা ঘোষণা সম্পর্কিত মন্ত্রিসভা বৈঠকে বিরোধী দলীয় নেতা অথবা তার অনুপস্থিতিতে বিরোধী দলীয় উপনেতার উপস্থিতি অন্তর্ভুক্ত করা হবে। (৩) জরুরি অবস্থাকালীন সময়ে নাগরিকের দুইটি অধিকার অলঙ্ঘনীয় করার লক্ষ্যে এ মর্মে বিধান করা হবে যে, “অনুচ্ছেদ ৪৭ক এর বিধান সাপেক্ষে, কোনো নাগরিকের—(ক) জীবনের অধিকার (Right to life); (খ) বিচার ও দণ্ড সম্পর্কে বিদ্যমান সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদে বর্ণিত মৌলিক অধিকারসমূহ খর্ব করা যাইবে না।” [২৯টি দল ও জোট একমত]

রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি
৭। মূলনীতিসমূহ : সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি অংশে ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার, গণতন্ত্র এবং ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সম্প্রীতি’ উল্লেখ থাকবে। [৩১টি দল ও জোট একমত]।

৮। সকল সম্প্রদায়ের সহাবস্থান ও মর্যাদা : সংবিধানে যুক্ত করা হবে যে, “বাংলাদেশ একটি বহু-জাতি, বহু-ধর্মী, বহু-ভাষী ও বহু-সংস্কৃতির দেশ যেখানে সকল সম্প্রদায়ের সহাবস্থান ও যথাযথ মর্যাদা নিশ্চিত করা হইবে।” [৩৩টি দল ও জোট একমত]

মৌলিক অধিকার
৯। মৌলিক অধিকারসমূহের তালিকা সম্প্রসারণ : সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশ মোতাবেক সংবিধানের তৃতীয় ভাগে বর্ণিত মৌলিক অধিকারসমূহের তালিকা সংশোধন ও নাগরিকদের অধিকার সম্প্রসারণ করা হবে। (নাগরিকের মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ, সেগুলোর সুরক্ষা ও বাস্তবায়নে সাংবিধানিক ও আইনি ব্যবস্থা নিশ্চিত করার বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রতিবেদনের পরিশিষ্টে উল্লেখ করা হয়েছে) । [৩১টি দল ও জোট একমত]

রাষ্ট্রপতি
১০। রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতি : সংবিধানে এরূপ যুক্ত করা হবে যে, বাংলাদেশের একজন রাষ্ট্রপতি থাকবেন, যিনি আইন অনুযায়ী আইনসভার উভয় কক্ষের (নিম্নকক্ষ ও উচ্চকক্ষ) সদস্যদের গোপন ভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে নির্বাচিত হবেন। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার ক্ষেত্রে বিদ্যমান সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৪৮ (৪) এ বর্ণিত যোগ্যতাসমূহ এবং রাষ্ট্রপতি পদে প্রার্থী হওয়ার সময় কোনো ব্যক্তি কোনো রাষ্ট্রীয়, সরকারি বা রাজনৈতিক দল বা সংগঠনের পদে থাকতে পারবেন না। [২৮টি দল ও জোট একমত; নোট অব ডিসেন্ট- ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ]

১১। রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও দায়িত্ব : রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতায় ভারসাম্য আনয়নের লক্ষ্যে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৪৮(৩) সংশোধনীর প্রস্তাব করে কারো পরামর্শ বা সুপারিশ ছাড়াই নিজ এখতিয়ারবলে রাষ্ট্রপতি নিম্নলিখিত পদে নিয়োগ প্রদান করতে পারবেন : (১) জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্যগণ, (২) তথ্য কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্যগণ, (৩) বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ও সদস্যগণ, (৪) আইন কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্যগণ, (৫) বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, (৬) এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্যগণ। [৩১টি দল ও জোট একমত; নোট অব ডিসেন্ট: প্রস্তাবতি ৫ ও ৬ নং ক্রমিকের বিষয় বিএনপি, এনডিএম, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, বাংলাদেশ লেবার পার্টি, ১২ দলীয় জোট, এলডিপি।

১২। রাষ্ট্রপতির অভিশংসন প্রক্রিয়া : সংবিধানে এরূপ যুক্ত করা হবে যে, “রাষ্ট্রদ্রোহ, গুরুতর অসদাচরণ বা সংবিধান লঙ্ঘনের জন্য রাষ্ট্রপতিকে অভিশংসন করা যাইবে। আইনসভার নিম্নকক্ষে অভিশংসন প্রস্তাবটি দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের ভোটে পাস করিবার পর তা উচ্চকক্ষে প্রেরণ এবং উচ্চকক্ষে শুনানির মাধ্যমে দুই-তৃতীয়াংশের সমর্থনে অভিশংসন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হইবে।” [২৮টি দল ও জোট একমত]

১৩। রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রদর্শন : কোনো আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ প্রদত্ত যেকোনো দণ্ডের মার্জনা, বিলম্বনস্থা ও বিরাম মঞ্জর করার এবং যে-কোনো দণ্ড মওকুফ, স্থগিত বা হ্রাস করার ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির থাকিবে এবং আইনের দ্বারা নির্ধারিত মানদণ্ড, নীতি ও পদ্ধতি অনুসরণক্রমে উক্ত ক্ষমতা প্রয়োগ করা হবে। সংশ্লিষ্ট আইনে এরূপ বিধান রাখা হবে যে, এরূপ কোনো আবেদন বিবেচনার পূর্বে মামলার বাদী বা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির পরিবারের সম্মতি গ্রহণ করা হবে। [২৯টি দল ও জোট একমত]

প্রধানমন্ত্রী ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার
১৪। প্রধানমন্ত্রীর পদের মেয়াদ : একজন ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী পদে যত মেয়াদ বা যত বারই হোক সর্বোচ্চ ১০ বছর থাকতে পারবেন, এ জন্যে সংবিধানের সংশ্লিষ্ট অনুচ্ছেদ সমূহের প্রয়োজনীয় সংশোধন করা হবে। [২৫টি দল ও জোট একমত; নোট অব ডিসেন্ট: বিএনপি, এনডিএম, ১২ দলীয় জোট, ও জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট]

১৫। প্রধানমন্ত্রীর একাধিক পদে থাকার বিধান : প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন ব্যক্তি একইসঙ্গে দলীয় প্রধানের পদে অধিষ্ঠিত থাকিবেন না, এরূপ বিধান সংবিধানে যুক্ত করা হবে। [নোট অব ডিসেন্ট: বিএনপি, এনডিএম, ১২ দলীয় জোট, ও জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট]।

১৬। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা: বিদ্যমান সংবিধানের ১২৩ (৩) অনুচ্ছেদ সংশোধন করে নিম্নরূপ বিধান সংযুক্ত করা হবে:

(১) মেয়াদ অবসানের কারণে অথবা মেয়াদ অবসান ব্যতীত অন্য কোনো কারণে সংসদ ভেঙ্গে যাওয়ার পরবর্তী নব্বই (৯০) দিনের মধ্যে সংসদ সদস্যদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। [২৯টি দল ও জোট একমত]

(২) সংবিধানের ৫৮ (খ) সংশোধনপূর্বক সংসদের মেয়াদ অবসান হওয়ার ১৫ দিন পূর্বে এবং মেয়াদ অবসান ব্যতীত অন্য কোনো কারণে সংসদ ভেঙ্গে গেলে ভঙ্গ হওয়ার পরবর্তী পনের (১৫) দিনের মধ্যে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগের বিষয়টি চূড়ান্ত করা হবে। [২৯টি দল ও জোট একমত]

(৩) মেয়াদ অবসানের ক্ষেত্রে সংসদের মেয়াদ অবসান হওয়ার ৩০ দিন পূর্বে জাতীয় সংসদের স্পিকারের তত্ত্বাবধানে এবং সংসদ সচিবালয়ের ব্যবস্থাপনায় — ১. প্রধানমন্ত্রী, ২. বিরোধী দলীয় নেতা, ৩. স্পিকার, ৪. ডেপুটি স্পিকার (বিরোধীদলের) এবং ৫. সংসদের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিরোধী দলের একজন প্রতিনিধি— (যদি সংসদে আসন সংখ্যার বিবেচনায় একাধিক দল দ্বিতীয় বৃহত্তম বিরোধীদলের অবস্থানে থাকে তাহলে সেসব দলের মধ্য থেকে নির্বাচনে সর্বোচ্চ পরিমাণে ভোটপ্রাপ্ত দলটিই দ্বিতীয় বৃহত্তম বিরোধীদল হিসেবে বিবেচিত হবে) মোট পাঁচ (৫) সদস্য সমন্বয়ে একটি ‘নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বাছাই কমিটি’ গঠিত হবে। কমিটির যেকোনো বৈঠক ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় সভাপতিত্ব করবেন স্পিকার।

(৪) কমিটি গঠিত হওয়ার পরবর্তী চব্বিশ (২৪) ঘণ্টার মধ্যে কমিটি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলসমূহ, সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক দলসমূহ এবং জাতীয় সংসদের স্বতন্ত্র সদস্যদের নিকট হতে সংবিধানের ৫৮গ অনুচ্ছেদে বর্ণিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হওয়ার যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তির নাম প্রস্তাবের আহবান করবেন এবং এক্ষেত্রে প্রতিটি দল ১ (এক) জন এবং একজন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য ১ (এক) জন মাত্র ব্যক্তির নাম প্রস্তাব করতে পারবে।

(৫) রাজনৈতিক দলসমূহ এবং স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যগণ পরবর্তী চব্বিশ (২৪) ঘণ্টার মধ্যে সংসদ সচিবালয়ে তাদের প্রস্তাবিত নাম দাখিল করবেন।

(৬) পরবর্তী বাহাত্তর (৭২) ঘণ্টার মধ্যে কমিটির সদস্যগণ সভায় মিলিত হয়ে নিজেদের অনুসন্ধানে প্রাপ্ত এবং রাজনৈতিক দলসমূহ ও স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যদের নিকট হতে প্রস্তাবিত নামসমূহ নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করত বাংলাদেশের যে সকল নাগরিক সংবিধানের ৫৮গ অনুচ্ছেদ এর অধীনে উপদেষ্টা হওয়ার যোগ্য তাদের মধ্য হতে একজনকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে বেছে নিবেন এবং তিনি রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হবেন।

(৭) বাছাই কমিটি গঠিত হওয়ার পরবর্তী একশত কুড়ি (১২০) ঘণ্টার মধ্যে এ পদ্ধতিতে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে কোনো ব্যক্তিকে চূড়ান্ত করা সম্ভব না হলে পরবর্তী আটচল্লিশ (৪৮) ঘণ্টার মধ্যে প্রধান উপদেষ্টা পদের জন্য ৫৮গ অনুচ্ছেদে বর্ণিত শর্ত অনুসরণপূর্বক সংসদের সরকারি দল/জোট ৫ (পাঁচ) জন উপযুক্ত ব্যক্তির নাম প্রস্তাব করবে এবং প্রধান বিরোধী দল/জোট ৫ (পাঁচ) জন উপযুক্ত ব্যক্তির নাম প্রস্তাব করবে। এছাড়া সংসদের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিরোধী দল ২ (দুই) জন উপযুক্ত ব্যক্তির নাম প্রস্তাব করবে। যদি সংসদে আসন সংখ্যার বিবেচনায় একাধিক দল দ্বিতীয় বৃহত্তম বিরোধীদলের অবস্থানে থাকে তাহলে সেসব দলের মধ্যে নির্বাচনে সর্বোচ্চ পরিমাণ ভোটপ্রাপ্ত দলটিই দ্বিতীয় বৃহত্তম বিরোধীদল হিসেবে বিবেচিত হবে। উপর্যুক্ত প্রক্রিয়ায় প্রাপ্ত নামসমূহ স্পিকার জনসাধারণের অবগতির জন্য প্রকাশ করবেন।

(৮) উপর্যুক্ত চ-এ বর্ণিত সময় অতিবাহিত হওয়ার পরবর্তী আটচল্লিশ (৪৮) ঘণ্টার মধ্যে সরকারি দল/জোটের প্রস্তাবিত ৫ (পাঁচ) জন ব্যক্তির নামীয় তালিকা হতে প্রধান বিরোধী দল/জোট যেকোনো ১ (এক) জনকে বেছে নিবে; অনুরূপভাবে প্রধান বিরোধী দল প্রস্তাবিত ৫ (পাঁচ) ব্যক্তির নামের তালিকা হতে সরকারি দল যেকোনো ১ (এক) জনকে বেছে নিবে। দ্বিতীয় বৃহত্তম বিরোধী দলের প্রস্তাবিত মোট ২ (দুই) জনের নামের তালিকা হতে সরকারি দল/জোট যেকোনো একজনকে বেছে নিবে এবং প্রধান বিরোধী দল/জোট যেকোনো ১ (এক) জনকে বেছে নিবে। এই পদ্ধতিতে প্রাপ্ত নামসমূহের মধ্য হতে যেকোনো একজনের ব্যাপারে যদি প্রস্তাবকারী দলগুলোর মধ্য ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়, তবে তিনিই পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসাবে মনোনীত হবেন। অথবা কোনো একজনের ব্যাপারে কমিটির ৫ (পাঁচ) জন সদস্যের মধ্যে যদি চার (৪) জন সদস্য একমত হন তাহলে তিনিই পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মনোনীত হবেন।

(৯) যদি উপর্যুক্ত পদ্ধতিতে কোনো একজনের বিষয়ে প্রস্তাবকারী পক্ষসমূহ একমত হতে না পারে তাহলে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বিচার বিভাগের দুইজন প্রতিনিধি বাছাই কমিটিতে সদস্য হিসেবে যুক্ত হবেন এবং তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে কারও নাম প্রস্তাব করতে পারবেন না। উক্ত দুইজন প্রতিনিধির মধ্যে এক (১) জন আপীল বিভাগের বিচারপতি হবেন এবং এক (১) জন হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি হবেন। উক্ত ২ (দুই) জন বিচার বিভাগীয় প্রতিনিধিকে মনোনীত করার জন্য—১. সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি, ২. কর্মরত প্রধান বিচারপতি এবং ৩. আপীল বিভাগের জ্যেষ্ঠতম বিচারপতি সমন্বয়ে তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠিত হবে।

(১০) এই পর্যায়ে ৭ (সাত) সদস্য বিশিষ্ট উক্ত বাছাই কমিটির সদস্যগণ পরবর্তী চব্বিশ (২৪) ঘণ্টার মধ্যে স্পিকারের তত্ত্বাবধানে গোপন ব্যালটে ‘র‌্যাংকড চয়েজ’ (Ranked Choice) বা ক্রমভিত্তিক ভোটিং পদ্ধতি প্রয়োগ করে উক্ত সংক্ষিপ্ত তালিকা হতে যেকোনো ১ (এক) জনকে পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে বেছে নিবেন।

(১১) উপর্যুক্ত যেকোনো পদ্ধতিতে মনোনীত ব্যক্তিকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে রাষ্ট্রপতি পরবর্তী নব্বই (৯০) দিনের জন্য প্রধান উপদেষ্টা পদে নিয়োগদান করবেন। তবে শর্ত থাকে যে, সংসদ বহাল থাকা অবস্থায় তিনি শপথ গ্রহণ করবেন না।

(১২) উপর্যুক্ত পদ্ধতিসমূহের মাধ্যমেও যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বেছে নেওয়া সম্ভব না হয় তাহলে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী অনুসরণ করতে হবে; তবে শর্ত থাকে যে, সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে বেছে নেওয়া যাবে না।

(১৩) কোনো কারণে প্রধান উপদেষ্টার পদ শূন্য হলে রাষ্ট্রপতি কোনো সময় ব্যতিরেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অবশিষ্ট মেয়াদের জন্য পূর্ববর্তী র‌্যাঙ্কড চয়েজ বা ক্রমভিত্তিক ভোটিং পদ্ধতিতে দ্বিতীয় স্থানে থাকা বয়সে জ্যেষ্ঠতম ব্যক্তিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা পদে নিয়োগদান করবেন। দ্বিতীয় স্থানে থাকা বয়সে জ্যেষ্ঠতম ব্যক্তি দায়িত্ব গ্রহণে অসম্মতি জানালে অথবা দায়িত্ব পালনে অপারগ হলে র‌্যাংক চয়েজ বা ক্রমভিত্তিক ভোটিং পদ্ধতিতে পরবর্তী স্থানে থাকা ব্যক্তি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা পদে অবশিষ্ট মেয়াদের জন্য নিযুক্ত হবেন। এই পদ্ধতিতে প্রধান উপদেষ্টা পদে পরিবর্তন হলেও পূর্বতন উপদেষ্টা পরিষদ বহাল থাকবে। তবে উপদেষ্টা পরিষদের কোনো পদ শূন্য হলে নবনিযুক্ত প্রধান উপদেষ্টা সেই শূন্যপদ পূরণের অধিকার রাখবেন।

(১৪) নিয়োগলাভের পর প্রধান উপদেষ্টা উপর্যুক্ত বাছাই কমিটির সঙ্গে পরামর্শক্রমে সংবিধানের ৫৮গ অনুচ্ছেদে বর্ণিত উপযুক্ত ব্যক্তিদের মধ্য হতে অনধিক ১৫ (পনেরো) জন ব্যক্তিকে উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগের জন্য বেছে নিবেন এবং রাষ্ট্রপতি তাঁদের নিয়োগ প্রদান করবেন।

(১৫) মেয়াদ অবসান ব্যতীত অন্য কোনো কারণে সংসদ ভেঙ্গে গেলে, ভঙ্গ হওয়ার পরবর্তী চব্বিশ (২৪) ঘণ্টার মধ্যে সংসদ সচিবালয়ের ব্যবস্থাপনায় বিলুপ্ত সংসদের একই ধরনের প্রতিনিধিত্ব নিয়ে ‘নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বাছাই কমিটি’ গঠিত হবে এবং উক্ত কমিটি পরবর্তী চৌদ্দ (১৪) দিন তথা ৩৩৬ (তিনশত ছত্রিশ) ঘণ্টার মধ্যে উক্তরূপ অভিন্ন পদ্ধতিতে ১ (এক) জন ব্যক্তিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে বেছে নিবে এবং তিনি অবিলম্বে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক প্রধান উপদেষ্টা নিযুক্ত হবেন।

(১৬) সংবিধানের ৫৮(৭)(ঘ) সংশোধনপূর্বক “বাহাত্তর বৎসরের অধিক বয়স্ক নহেন” এর পরিবর্তে “পঁচাত্তর বৎসরের অধিক বয়স্ক নহেন” শব্দসমূহ প্রতিস্থাপিত হবে।

(১৭) তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রধানমন্ত্রীর পদমর্যাদা ও সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবেন এবং উপদেষ্টাগণ মন্ত্রীর পদমর্যাদা ও সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবেন।

(১৮) সংবিধানে বর্ণিত বিধানাবলি সাপেক্ষে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্ব, কর্তব্য ও এখতিয়ার ও অবসানের সময়সীমা নির্ধারিত হবে।

(১৯) নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ হবে অনধিক নব্বই (৯০) দিন। তবে দৈব-দুর্বিপাকজনিত কারণে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব না হলে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার আরো সর্বোচ্চ ত্রিশ (৩০) দিন দায়িত্ব পালন করতে পারবে।

(২০) নতুন সংসদ গঠিত হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী যে তারিখে তাঁর পদের কার্যভার গ্রহণ করবেন সেই তারিখে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিলুপ্ত হবে।

* ত্রয়োদশ সংশোধনীর অনুচ্ছেদ ৫৮(গ) (২) ব্যবস্থা বহাল থাকবে। [নোট অব ডিসেন্ট: বিএনপি (গঠন প্রক্রিয়া সংসদের হাতে ন্যস্ত করার পক্ষে), বাংলাদেশ লেবার পার্টি (৯, ১০ ও ১৩), এনডিএম (৮, ৯, ১২), জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট (৯, ১০ ও ১৩), ১২ দলীয় জোট (৯, ১০ ও ১৩), জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদশে (৭ ও ৮), বাংলাদশে নেজামে ইসলাম পার্টি (৭ ও ১০)] ।

স্থানীয় সরকার
১৭। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহের নির্বাচন : সংবিধানে এরূপ যুক্ত করা হবে যে, “নির্বাচন কমিশনের সরাসরি তত্বাবধানে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবে।” [২৮টি দল ও জোট একমত]

১৮। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের আর্থিক ব্যবস্থাপনা : সংবিধানে এরূপ যুক্ত করা হবে যে, “সকল স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের আর্থিক ব্যবস্থাপনা এবং আইন দ্বারা নির্ধারিত সকল কাজ সম্পাদনের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ কার্যকরী স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করা হইবে। জাতীয় পরিকল্পনা বাস্তবায়ন কর্মসূচির অংশ না হইলে, স্থানীয় পর্যায়ে সকল উন্নয়নমূলক কাজের উপর স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের সম্পূর্ণ আর্থিক নিয়ন্ত্রণ এবং বাস্তবায়নের কর্তৃত্ব থাকিবে।” [২৬টি দল ও জোট একমত]

১৯। সরকারি কর্মকর্তা/কর্মচারীদের স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের অধীনে ন্যস্ত করা : সংবিধানে এরূপ যুক্ত করা হবে যে, “যে সকল সরকারি কর্মকর্তা/কর্মচারী স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের কাজে সরাসরি নিয়োজিত তাহারা স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের জনপ্রতিনিধিদের অধীনস্ত হইবেন এবং যে সকল সরকারি বিভাগ স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের এখতিয়ারভুক্ত উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে সম্পৃক্ত, তাহারা স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠা জনপ্রতিনিধিদের নির্দেশনায় কাজ করিবেন।” [২৬টি দল ও জোট একমত]

২০। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব তহবিল সংগ্রহ : সংবিধানে এরূপ যুক্ত করা হবে যে, “স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান স্থানীয়ভাবে নিজস্ব তহবিল সংগ্রহ করিতে পারিবে। তবে প্রাক্কলিত তহবিল যদি স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের বাজেটের চাইতে কম হইবার সম্ভাবনা থাকে, তাহা হইলে সেই বাজেট আইনসভার উচ্চকক্ষের স্থানীয় সরকার সম্পর্কিত কমিটির নিকট পাঠাইতে হইবে।” [২৩টি দল ও জোট একমত]

আইনসভা
২১। আইনসভা গঠন : সংবিধানে যুক্ত করা হবে যে,

“(ক) বাংলাদেশে একটি দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা থাকিবে, যাহার নিম্নকক্ষ (জাতীয় সংসদ) এবং উচ্চকক্ষ (সিনেট) ১০০ (একশত) সদস্য নিয়ে নিয়ে গঠিত হইবে।” [৩২টি দল ও জোট একমত ও নোট অব ডিসেন্ট: সিপিবি]

(খ) নিম্নকক্ষের নির্বাচনে প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (Proportional Representation- PR) পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষের ১০০ (একশত) জন সদস্য নির্বাচিত হইবেন। [নোট অব ডিসেন্ট: বিএনপি, এনডিএম]

(গ) উচ্চকক্ষের মেয়াদ হইবে শপথ গ্রহণের তারিখ হইতে ৫ (পাঁচ) বছর। তবে কোনো কারণে নিম্নকক্ষ ভাঙ্গিয়া গেলে উচ্চকক্ষ স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিলুপ্ত হইবে।

(ঘ) রাজনৈতিক দলগুলো নিম্নকক্ষের সাধারণ নির্বাচনের চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা প্রকাশের সময় একই সঙ্গে উচ্চকক্ষের প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করিবে। তালিকায় কমপক্ষে ১০% নারী প্রার্থী থাকিতে হইবে।”[২৭টি দল ও জোট একমত; নোট অব ডিসেন্টঃ বিএনপি, এনডিএম]

২২। উচ্চকক্ষের দায়িত্ব ও ভূমিকা : উচ্চকক্ষ নিম্নোক্ত দায়িত্বসমূহ পালন করবে :

(ক) নিম্নকক্ষের প্রস্তাবিত আইন প্রণয়নের পর্যালোচনা করবে। উচ্চকক্ষের আইন প্রণয়নের ক্ষমতা থাকবেনা; তবে কোনো জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আইন প্রণয়নের জন্য নিম্নকক্ষ বরাবর প্রস্তাব করতে পারবে। নিম্নকক্ষে পাসকৃত অর্থবিল এবং আস্থা ভোট ব্যতীত সকল বিল উচ্চকক্ষে উপস্থাপিত হতে হবে। উচ্চকক্ষ কোনো বিল স্থায়ীভাবে আটকাতে পারবে না। উচ্চকক্ষ কোনো বিল সর্বোচ্চ ২ (দুই) মাসের বেশি আটকে রাখলে, তা উচ্চকক্ষ কর্তৃক অনুমোদিত বলে বিবেচিত হবে।

(খ) যদি উচ্চকক্ষ কোনো বিল অনুমোদন করে সেক্ষেত্রে উভয় কক্ষ কর্তৃক পাসকৃত বিল রাষ্ট্রপতির সম্মতির জন্য পাঠানো হবে।

(গ) যেক্ষেত্রে উচ্চকক্ষ সংশোধনের সুপারিশসহ বিল পুনর্বিবেচনার জন্য নিম্নকক্ষে পাঠাবে সেক্ষেত্রে নিম্নকক্ষ উচ্চকক্ষের প্রস্তাবিত সংশোধনগুলো সম্পূর্ণ ও আংশিকভাবে গ্রহণ বা প্রত্যাখ্যান করতে পারবে।

(ঘ) উচ্চকক্ষের কাছ থেকে ফেরত পাঠানো বিল যদি নিম্নকক্ষের অধিবেশনে আবারও পাস হয়, তবে উচ্চকক্ষের অনুমোদন ছাড়াই বিলটি রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের জন্য প্রেরিত হবে।

(ঙ) সংবিধান সংশোধন সংক্রান্ত যেকোনো বিল উচ্চকক্ষের সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় পাস করতে হবে।

উল্লেখিত বিধান অন্তর্ভুক্তির লক্ষ্যে সংবিধানের পঞ্চম ভাগে প্রয়োজনীয় সংযোজন ও সংশোধন করা হবে।

এই পোস্ট টি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরও সংবাদ
© All rights reserved © 2023 amadersomoy.net
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com