ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে মরদেহে গভীর আঘাতের ৯ চিহ্ন

আমাদের সময় ডেস্ক
  • আপডেট সময় মঙ্গলবার, ১২ আগস্ট, ২০২৫

ধারালো অস্ত্রের আঘাতে গলার ডান পাশের সব ধমনি (রক্ত চলাচলের নালি) কেটে যায়। চাপাতির কোপে ক্ষতবিক্ষত বুকের বা পাশের পাঁজর। অন্য আরেকটি কোপ পিঠ দিয়ে ঢুকে ফুসফুস বিচ্ছিন্ন হয়ে পাঁজর ভেদ করে বেরিয়ে যায় বুক দিয়ে। টুকরো টুকরো হয়েছে বাঁ-হাতের হাড়। গাজীপুরে সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিন হত্যার এমন নৃশংসতার চিত্র উঠে এসেছে শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে করা ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে। গত রোববার রাতে প্রতিবেদনটি পুলিশের কাছে জমা দেয় ওই স্বাস্থ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির ফরেনসিক বিভাগ। যাতে তুহিনের মরদেহের গলা, ঘাড়, বুক, পিঠ ও হাতে ধারালো অস্ত্রের কোপে গুরুতর ৯টি গভীর আঘাতের চিহ্ন পাওয়ার কথা জানানো হয়েছে।

এদিকে, দেশজুড়ে আলোড়ন তোলা এই হত্যার ঘটনায় হওয়া মামলায় গ্রেপ্তার ৭ আসামিকে দুই দিনের রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে আদালতে হাজির করা হলে নিজের দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন শাহজালাল নামে একজন। পরে বিচারক শুনানি শেষে এই আসামিদের কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।

গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. এ এন এম আল মামুন বলেন, ‘সাংবাদিক তুহিনের গলা, ঘাড়, বুক, পিঠ ও হাতে গুরুতর ৯টি আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। একটির চেয়ে আরেকটি আঘাত কোনোভাবেই ছোট নয়। সব আঘাতই সমান গুরুতর, সব আঘাতই গভীর।’

একজন মানুষের মৃত্যুর জন্য এ ধরনের যে কোনো একটি আঘাতই যথেষ্ট বলে জানান ফরেনসিক বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. মাজহারুল হক। তিনি বলেন, ‘৯টি আঘাতের মধ্যে সবচেয়ে বেশি গভীর হয়েছে বুকের বাঁ পাশে। টুকরো টুকরো করে ফেলা হয়েছে বাঁ হাতের হাড়।’ ময়নাতদন্তের এ প্রতিবেদন এরই মধ্যে গাজীপুর মহানগর পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে বলে জানান অধ্যাপক মাজহারুল হক।

এর আগে সাংবাদিক তুহিনের মরদেহের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার ১৫ দিনের মধ্যেই আসামিদের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট (অভিযোগপত্র) দেওয়ার কথা জানিয়েছিলেন গাজীপুর মহানগর পুলিশ কমিশনার ড. মো. নাজমুল করিম খান। গত শনিবার দুপুরে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ কমিশনার বলেন, ‘সংঘবদ্ধ চক্রের অপরাধের ভিডিওচিত্র ধারণ করতে গিয়ে জীবন দিয়েছেন সাংবাদিক তুহিন। আমাদের কাছে এ ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজ রয়েছে, প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী আছে। সব তথ্য-প্রমাণ রয়েছে। তুহিনের মরদেহের ময়নাতদন্ত রিপোর্ট প্রাপ্তি সাপেক্ষে আমরা আগামী ১৫ দিনের মধ্যেই আদালতে চার্জশিট দিতে পারব।’

সাংবাদিক তুহিন হত্যা মামলার অগ্রগতি প্রসঙ্গে গাজীপুর মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (অপরাধ-উত্তর) মো. রবিউল হাসান গতকাল সোমবার কালবেলাকে বলেন, ‘গতকাল (রোববার রাতে) ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন আমরা হাতে পেয়েছি। এ ছাড়া হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িত ৭ আসামিকে শনিবার রাতেই ২ দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়। রোববার থেকে তাদের রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হয়।’

আদালতে দায় স্বীকার শাহজালালের: সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিন হত্যার আলোচিত মামলায় রিমান্ডে নেওয়া সাত আসামির মধ্যে একজন ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। বাসন থানায় দুই দিনের রিমান্ড শেষে এই সাত আসামিকে গতকাল দুপুরে গাজীপুরের চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত-৩-এ হাজির করা হয়। তাদের মধ্যে কুমিল্লার হোমনা থানার অনন্তপুর এলাকার হানিফ ভূঁইয়ার ছেলে মো. শাহজালাল (৩২) আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা উপপরিদর্শক দুলাল চন্দ্র দাস বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। পরে আদালত সাত আসামিকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।

তদন্ত কর্মকর্তা দুলাল চন্দ্র দাস বলেন, ‘দুদিনের রিমান্ড শেষে কড়া পুলিশি পাহারায় সাত আসামিকে আদালতে হাজির করা হয়। এদের মধ্যে আসামি শাহজালালকে আদালতের বিচারক ওমর হায়দারের সামনে হাজির করা হলে সাংবাদিক তুহিন হত্যায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে জবানবন্দি দেয়।’

তদন্ত কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘রিমান্ডে থাকা অবস্থায় সাত আসামিকে আলাদাভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এসময় তারা তুহিন হত্যা সম্পর্কে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছে। তাদের দেওয়া তথ্যগুলো যাচাই-বাছাই করা হবে।’ তবে তদন্তের স্বার্থে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেন এ পুলিশ কর্মকর্তা।

পুলিশের একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানান, জবানবন্দিতে শাহজালাল ইয়াবা কারবার এবং ছিনতাইয়ে জড়িত থাকার কথা জানায়। গত ৭ আগস্ট সে, মিজান, স্বাধীন, সুমন, আরমান, ফয়সাল এবং আল-আমিন একসঙ্গে ইয়াবা সেবন করছিল। এ সময় মিজানের স্ত্রী গোলাপি ফোন দিয়ে মিজানকে জানায়, শাপলা ম্যানশনের কাছে একটা লোক পাওয়া গেছে, তার থেকে ফিটিং দিয়ে (নারী সদস্যকে দিয়ে প্রলোভনে ফেলে সর্বস্ব কেড়ে নেওয়া) টাকা-পয়সা পাওয়া যাবে। কিছুক্ষণের মধ্যে তারা চাপাতি, দা সুইচ গিয়ার চাকু নিয়ে শাপলা ম্যানশনের দিকে গিয়ে গোলাপিকে ওই লোকের সঙ্গে হাতাহাতি করতে দেখে দৌড়ে গিয়ে এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকে। কোপ খেয়ে ওই ব্যক্তি একটা মুদি দোকানে ঢুকেন। এসময় গোলাপি চিৎকার করে বলতে থাকে, ‘তুহিন সাংবাদিক ভিডিও করছে।’ সঙ্গে সঙ্গে ওই ব্যক্তিকে কোপানো বাদ দিয়ে সাংবাদিক তুহিনকে ধাওয়া করে চায়ের দোকানের সামনে নিয়ে প্রথমে মিজান দা দিয়ে কোপ মারে, কোপ খেয়ে দোকানের ভেতরে ঢুকলে স্বাধীন, সুমন, আরমান, আল-আমিন ও ফয়সাল মিলে এলোপাতাড়ি কোপায়। আর মিজান সুযোগ বুঝে সাংবাদিক তুহিনের মোবাইল ফোন পকেটে নিয়ে যায়। এরই মধ্যে গোলাপি পুলিশ আসতেছে বলে চিৎকার করলে হামলাকারীরা সবাই পালিয়ে যায়।

এই পোস্ট টি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরও সংবাদ
© All rights reserved © 2023 amadersomoy.net
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com