বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) ডেসপাস রাইডার খলিলুর রহমান। দপ্তরের ফাইল আনা-নেওয়াই তার কাজ। প্রতিষ্ঠানটির এই কর্মচারী এক যুগ ধরে পিএসসির বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করে আসছেন। আর এই অবৈধ টাকায় গড়েছেন অন্তত ৬০ কোটি টাকার সম্পত্তি। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) জিজ্ঞাসাবাদ ও আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে তিনি এ তথ্য জানিয়েছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
গত ৯ জুলাই আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন খলিলুর। এর আগে গ্রেপ্তারের পর সিআইডির জিজ্ঞাসাবাদ ও আদালতে তার দেওয়া স্বীকারোক্তির বরাতে জানা গেছে, অবৈধ উপায়ে অর্জন করা তার সম্পদের মধ্যে রাজধানীর মিরপুরের মধ্য পীরেরবাগে রয়েছে আলিশান ফ্ল্যাট, যার দাম অন্তত ৩ কোটি টাকা। কয়েক মাস আগে নতুন এ ফ্ল্যাট কেনেন তিনি। ওই বাসার ইন্টেরিয়র করেছেন লাখ লাখ টাকা খরচ করে। এর বাইরে ঢাকায় আরেকটি ফ্ল্যাটের সন্ধান পেয়েছে সিআইডি। সম্প্রতি মধ্য পীরেরবাগের বাসায় ওঠায় পুরোনো ফ্ল্যাটটিতে আর থাকছেন না তিনি। নতুন বাসা থেকেই গ্রেপ্তার হন তিনি। এর বাইরে যশোরের কেশবপুর ও রাজধানীর আশকোনা এলাকায় বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি কিনেছেন খলিলুর।
আদালত সূত্রে জানা গেছে, স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে খলিলুর জানিয়েছেন, গত এক যুগে প্রশ্নফাঁস করে অন্তত ৪০০ জনকে চাকরি পেতে সহায়তা করেছেন তিনি। এর মধ্যে বিসিএস ক্যাডার,
নন-ক্যাডার ও পিএসসির অধীনে অন্যান্য নিয়োগ পরীক্ষাও রয়েছে। তিনি মূলত পিএসসির পরিচালকদের এমএলএসএস, অফিস সহায়কদের সহায়তায় প্রশ্নপত্র ফাঁস করতেন। তিনি ৩৩তম বিসিএস পরীক্ষায় ১০ জন প্রার্থীর কাছে ফাঁস করা প্রশ্নপত্র বিক্রি করেন। এর মধ্যে তিনজন বর্তমানে বিভিন্ন ক্যাডারে চাকরি করছেন।
প্রশ্ন পাওয়া প্রার্থীদের মধ্যে ছয়জন লিখিত পরীক্ষায় উতরে যান। তবে তিনজন পরে মৌখিক পরীক্ষায় বাদ পড়েন বলে ঢাকার একটি মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে জানান প্রশ্নফাঁসের দায়ে অভিযুক্ত খলিলুর।
জবানবন্দিতে খলিলুর আরও জানিয়েছেন, পিএসসির সাবেক এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার কাছে তিনি চাকরিপ্রার্থীদের পরিচয় করিয়ে দিতেন। সেখান থেকে সবুজ সংকেত মিললে নিয়োগের বিষয়ে আর্থিক লেনদেনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হতো। সহকারী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা ও রেলের নিয়োগগুলোতে তার কারসাজি চলত।
২০১২ সালে ৩৩তম বিসিএস পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগে গ্রেপ্তার হন খলিলুর রহমান। সে সময় তাকে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলাও হয়; কিন্তু সাক্ষ্য প্রমাণের অভাবে শাহবাগ থানায় হওয়া মামলা ও বিভাগীয় মামলা থেকে ২০২২ সালের মার্চে দায়মুক্তি পান তিনি। টানা ১০ বছর সাময়িক বরখাস্তের সময়ের বকেয়া
বেতন-ভাতাও ফেরত পান।
পিএসসির দুই উপপরিচালকসহ ছয় আসামির রিমান্ড আবেদন: বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় পিএসসির দুই উপপরিচালকসহ ছয় আসামিকে ১০ দিনের রিমান্ডে নিতে আবেদন করেছে সিআইডি। গতকাল মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সিআইডির অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার জুয়েল চাকমা আদালতে এ আবেদন করেন। তাদের রিমান্ডে নেওয়ার জন্য নয়টি কারণ উল্লেখ করা হয়েছে। আগামী ১৬ জুলাই কারাগারে আটক ৬ আসামির উপস্থিতিতে রিমান্ড শুনানি হবে।
রিমান্ডে নিতে যেসব কারণ উল্লেখ করা হয়েছে, সেগুলো হলো—বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের অধীন বাংলাদেশ রেলওয়ের সাব-অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার (নন-ক্যাডার) নিয়োগ পরীক্ষার মূল প্রশ্ন তারা কীভাবে সংগ্রহ করতেন এবং তাদের কে সরবরাহ করতেন, প্রশ্ন ফাঁসের এ চক্রটির সঙ্গে আর কারা কারা জড়িত, কীভাবে তারা প্রশ্ন ফাঁস করতেন, কারা কারা কীভাবে তাদের কাছ থেকে প্রশ্ন সংগ্রহ করতেন, কীভাবে নিয়োগ প্রার্থী পরীক্ষার্থীর কাছে ওই পদের প্রশ্ন এবং প্রশ্নের উত্তর বিতরণ করতেন, কতজন নিয়োগ প্রার্থী পরীক্ষার্থীর কাছে ওই পদের প্রশ্ন এবং প্রশ্নের উত্তর বিতরণ করা হয়েছে, প্রশ্নফাঁসের এই চক্রটির দ্বারা প্রশ্নফাঁসের মাধ্যমে মোট কত পরিমাণ অর্থ লেনদেন হয়েছে, লেনদেনকৃত অর্থের সুবিধাভোগীদের শনাক্তকরণ, মামলা সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ আলামত উদ্ধার।
রিমান্ড চাওয়া আসামিরা হলেন পিএসসির উপপরিচালক মো. আবু জাফর ও মো. জাহাঙ্গীর আলম, সহকারী পরিচালক মো. আলমগীর কবির, সাবেক সেনাসদস্য নোমান সিদ্দিকী, অডিটর প্রিয়নাথ রায় ও ব্যবসায়ী মো. জাহিদুল ইসলাম। তবে কারাগারে থাকা গাড়িচালক আবেদের ছেলে সোহানুর রহমান সিয়াম, নারায়ণগঞ্জ পাসপোর্ট অফিসের নিরাপত্তা প্রহরী শাহাদাত হোসেন, ঢাকার ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অফিসে কর্মরত মো. মামুনুর রশীদ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের মেডিকেল টেকনিশিয়ান মো. নিয়ামুন হাসানের কোনো আবেদন করা হয়নি।
আবেদ আলীসহ চারজনের জামিন নামঞ্জুর: রাজধানীর পল্টন থানার মামলায় গ্রেপ্তার পিএসসির চেয়ারম্যানের সাবেক গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলী জীবনসহ চার আসামির জামিনের আবেদন নামঞ্জুর করেছেন আদালত। গতকাল ঢাকার অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. তোফাজ্জল হোসেনের আদালতে আসামিদের পক্ষে আইনজীবীরা জামিন চেয়ে শুনানি করেন। শুনানি শেষে আদালত জামিন নামঞ্জুরের আদেশ দেন। জামিন নামঞ্জুর হওয়া অন্য তিন আসামি হলেন পিএসসির অফিস সহায়ক খলিলুর রহমান, ব্যবসায়ী আবু সোলায়মান মো. সোহেল ও লিটন সরকার।
এর আগে গত ৯ জুলাই গ্রেপ্তার ১৭ আসামিকে আদালতে হাজির করা হয়। এর মধ্যে পিএসসির চেয়ারম্যানের সাবেক গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলী জীবনসহ সাত আসামি স্বেচ্ছায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে সম্মত হন। পরে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সিআইডির অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার জুয়েল চাকমা তাদের জবানবন্দি রেকর্ড করার আবেদন করেন। তবে এদের মধ্যে আবু সোলায়মান মো. সোহেল নামে এক আসামি স্বীকারোক্তি দিতে অস্বীকৃতি জানান। পরে স্বীকারোক্তি বাদেই তাকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। এ মামলায় দায় স্বীকার করা আসামিরা হলেন পিএসসির চেয়ারম্যানের সাবেক গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলী জীবন, ডেসপাস রাইডার খলিলুর রহমান, অফিস সহায়ক সাজেদুল ইসলাম, ব্যবসায়ী সহোদর সাখাওয়াত হোসেন ও সায়েম হোসেন এবং বেকার যুবক লিটন সরকার।
গত ৮ জুলাই রাজধানীর পল্টন থানায় পিএসসির আইনে সিআইডির উপপরিদর্শক নিপ্পন চন্দ্র চন্দ মামলা করেন। মামলায় ৩১ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতপরিচয় ৫০-৬০ জনকে আসামি করা হয়েছে। এজাহারনামীয় আসামির মধ্যে সাবেক সহকারী পরিচালক নিখিল চন্দ্র রায়, শরীফুল ইসলাম ভূঁইয়া, দীপক বণিক, মো. খোরশেদ আলম খোকন, কাজী মো. সুমন, একেএম গোলাম পারভেজ, মেহেদী হাসান খান, মো. গোলাম হামিদুর রহমান, মুহা. মিজানুর রহমান, আতিকুল ইসলাম, এটিএম মোস্তফা, মাহফুজ কালু, আসলাম ও কৌশিক দেবনাথ পলাতক।