নাম বদলেও ‘স্বস্তি’ দেখছেন না আইনজ্ঞরা

আমাদের সময় ডেস্ক
  • আপডেট সময় মঙ্গলবার, ৮ আগস্ট, ২০২৩

ঢাকা: বহু আলোচনা-সমালোচনার পর অবশেষে বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পরিবর্তনের প্রস্তাবে সম্মতি দিয়েছে সরকার। আইনটির নাম বদলে ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন-২০২৩’করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, যা আসছে সংসদ অধিবেশনে পাস হওয়ার কথা রয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের যেসব ধারা নিয়ে বেশি বিতর্ক ছিল কয়েকটি ক্ষেত্রে সেগুলোর সাজা কমিয়ে আনা হলেও নতুন আইনে ডিজিটাল আইনের অধিকাংশ ধারা থাকছে। এসব ধারা বাদ না গেলে নাম পরিবর্তন করেও মানুষকে ভোগান্তির শিকার হতে হবে বলে আশঙ্কা করছেন আইনজ্ঞরা।

অবশ্য সরকারের পক্ষ থেকে নতুন আইনে কিছু পরিবর্তন আনার কথা বলা হয়েছে। তাহলে কী পুরোনো আইনের কেবল খোলস বদল করা হয়েছে এমন প্রশ্নও আইনজ্ঞদের।

দেশের সাংবাদিক, আইনজীবী, বুদ্ধিজীবীদের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর আপত্তি ও উদ্বেগের মধ্যে ২০১৮ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদে পাস হয় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। এরপর থেকে বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক সংগঠন এই আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার হয়।
আইসিটি অ্যাক্ট এর ৫৭ ধারা বিলোপ করে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে প্রতিস্থাপন করা হয়েছিল। এখন নাম পরিবর্তন করে সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট করা হচ্ছে। ধারা বহাল রেখে নাম পরিবর্তন করা হলে তা হবে কেবল পাত্র পরিবর্তন করার মতো। এটা হলে যারা ভুক্তভোগী সাধারণ নাগরিক তারা কোনোভাবে উপকৃত হবে না।
জ্যেতির্ময় বড়ুয়া, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী

তাদের দাবি, দেশের সংবিধানের মৌলিক চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মাধ্যমে জনগণের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করা হয়েছে। শুধু তাই নয় এই আইনে গণমাধ্যমকর্মী, শিক্ষক, ছাত্র, শিল্পীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে হয়রানি করা হয়েছে। এ আইনকে বিরোধী মত দমনের অন্যতম হাতিয়ারও বানানো হয়। বহু সমালোচনার পর অবশেষে বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পরিবর্তনে সম্মতি দেয় সরকার।

তথ্যমতে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করার পর এখন পর্যন্ত সারাদেশে মোট সাত হাজার একটি মামলা হয়। তবে নাম পরিবর্তন করা হলেও পূর্বে দায়ের করা মামলায় আদালতের বারান্দায় যেতে হবে আসামিদের।

অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮ পরিবর্তন করে নতুন আইন করার সিদ্ধান্ত নিলেও এই আইনে চলমান মামলাগুলো বাতিল হবে না। মামলাগুলোর বিচার আগের আইনেই চলবে।

অ্যাটর্নি জেনারেল ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পরিবর্তনের সিদ্ধান্তকে ইতিবাচক বলে উল্লেখ করলেও অনেক আইনজ্ঞ এতে দ্বিমত পোষণ করেন। তাদের মতে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের যেসব ধারা নিয়ে বেশি বিতর্ক ছিল কয়েকটি ক্ষেত্রে সেগুলোর সাজা কমিয়ে আনা হলেও নতুন আইনে ডিজিটাল আইনের অধিকাংশ ধারা থাকছে। নিবর্তনমূলক’ এসব ধারা বাদ না গেলে নাম পরিবর্তন করেও লাভ হবে না।

এসব আইনজ্ঞ বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি এতটাই নিপীড়ন ও নিবর্তনমূলক আইন যে, এটা করাই হয়েছে মানুষকে হয়রানির জন্য। নতুন আইনে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে বাধা দূর করতে হবে। হয়রানিমূলক মামলা করার বিধান বাদ দিতে হবে। যার মানহানি হবে শুধুমাত্র তিনিই মামলা করতে পারবেন সেই বিধান যুক্ত করতে হবে। এছাড়া একই ঘটনায় দেশের বিভিন্ন জায়গায় মামলা করা যাবে না। এছাড়া রাজনৈতিক বিবেচনায় করা মামলা গ্রহণ করা যাবে না।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি এতটাই নিপীড়ন ও নিবর্তনমূলক আইন যে, এটা করাই হয়েছে মানুষকে হয়রানি করার জন্য। নতুন আইনে ২৮, ২৯, ৩০, ৩১ এবং ৩২ ধারা থাকছেই।

তিনি বলেন, এর আগে আইসিটি অ্যাক্ট এর ৫৭ ধারা বিলোপ করে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে প্রতিস্থাপন করা হয়েছিল। এখন নাম পরিবর্তন করে সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট করা হচ্ছে। ধারা বহাল রেখে নাম পরিবর্তন করা হলে তা হবে কেবল পাত্র পরিবর্তন করার মতো। এটা হলে যারা ভুক্তভোগী সাধারণ নাগরিক তারা কোনোভাবে উপকৃত হবে না।

বিএনপির আইন বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেন, মানুষের কথা বলা ও মতপ্রকাশের সাংবিধানিক অধিকারকে ভুলণ্ঠিত করার জন্য নতুনভাবে সাইবার নিরাপত্তা আইন-২০২৩ করা হয়েছে।

কায়সার কামাল বলেন, যেহেতু এই সরকার অনির্বাচিত এবং জনগণের ম্যান্ডেট ছাড়া রাষ্ট্র পরিচালনা করছে। কাজেই এ সরকারের কোনো কাজে জনগণের আকাঙ্খার প্রতিফলন হবে না।

বিএনপির এই আইন বিষয়ক সম্পাদক আরও বলেন, এই সরকারের কাছ থেকে জনগণ, সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবী কারও প্রত্যাশাই এই জঘন্য বা কলো আইন পূরণ করবে না।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. শিশির মনির বলেন, নতুন আইনে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে বাধা দূর করতে হবে। হয়রানিমূলক মামলা করার বিধান বাদ দিতে হবে।

শিশির মনির বলেন, ‘যার মানহানি হবে শুধুমাত্র তিনিই মামলা করতে পারবেন সেই বিধান যুক্ত করতে হবে। এছাড়া একই ঘটনায় দেশের বিভিন্ন জায়গায় মামলা করা যাবে না।

সুপ্রিম কোর্টের এই আইনজীবী বলেন, রাজনৈতিক বিবেচনায় করা মামলা গ্রহণ করা যাবে না। আইনের সঙ্গায় অপরাধের বর্ণনা সুনির্দিষ্টভাবে থাকতে হবে। অস্পষ্ট সংজ্ঞা দেওয়া যাবে না।

কী বলছে সরকার?

সাইবার নিরাপত্তা আইন-২০২৩ এর বিষয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেছেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কিছু অপব্যবহার কিংবা মিসইউজ রোধ করতে আমরা নাম পরিবর্তন করেছি। যেমন, আগে মানহানিতে কারাদণ্ড ছিল, সেখানে এখন কারাদণ্ড নেই। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন থাকলে একটা মানসিক চাপ থেকে যায়। স্বাধীন সংবাদ পরিবেশনে একটি মানসিক চাপ থাকে। সেটিকেও আমরা কর্তব্যের মধ্যে নিয়েছি। এ কারণে আমরা পরিবর্তন করেছি।

আইনমন্ত্রী বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের রহিতকরণ ও হেফাজতকরণের প্রভিশন রেখে আমরা সাইবার নিরাপত্তা নিরাপত্তা আইন করেছি।

আনিসুল হক বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ধারা ২১-এ বাংলাদেশের ভাবমূর্তি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশের পতাকা ও জাতীয় সঙ্গীত- এসব নিয়ে যদি কেউ কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করে, তাহলে সেটিকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছিল। এর সাজা ছিল ১০ বছর কারাদণ্ড, এটি কমিয়ে এখন সাত বছর করা হয়েছে।

আইনমন্ত্রী বলেন, যেগুলো টেকনিক্যাল অফেন্স, সেগুলো কিন্তু আমরা জামিনযোগ্যও করিনি, সাজাও কমানো হয়নি, ৩০ ধারা থাকবে। ৩১ ধারায় আগে ছিল সাত বছর, এখন কমিয়ে আনা হয়েছে পাঁচ বছরে। ৩২ ধারায় সরকারি গোপনীয়তা ভঙ্গের অপরাধে আগে ছিল ১৪ বছর এখন সাত বছর করা হয়েছে। এখানেও পুনঃসংগঠন করলে যে শাস্তি, তা বাতিল করা হয়েছে।

আনিসুল হক আরও বলেন, হ্যাকিং সংক্রান্ত অপরাধ বলে একটি অপরাধ এখানে নতুন করে সৃষ্টি করা হয়েছে। সেটিতে ১৪ বছরের কারাদণ্ড করা হয়েছে। ৩৩ ধারায় বেআইনি তথ্য, উপাত্ত ধারণ, হস্তান্তর, স্থানান্তর ইত্যাদি, এটিকে হ্যাকিং নামে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। আমার মনে হয়, ৩৩ ধারাটিকে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত করে হ্যাকিং এর অপরাধ করা হয়েছে। যদি কোনো ব্যক্তি হ্যাক করেন, তাহলে সেটি হবে একটি অপরাধ। সেজন্য তিনি অনধিক ১৪ বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক এক কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

তিনি বলেন, হ্যাকিং মানে বলা হয়েছে, কম্পিউটারের তথ্যভাণ্ডার থেকে কোনো তথ্য বিনাশ বাতিল, পরিবর্তন, এর মূল্য বা উপযোগিতা হ্রাসকরণ, অন্য কোনোভাবে ক্ষতি সাধন, নিজ মালিকানা বা দখলবিহীন কম্পিউটার সার্ভার, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, অন্য কোনো ইলেকট্রনিক সিস্টেমে অবৈধভাবে প্রবেশের মাধ্যমে এর ক্ষতি সাধন।

এই পোস্ট টি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরও সংবাদ
© All rights reserved © 2023 amadersomoy.net
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com