আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর দখলবাজিতে এক মাস ধরে অস্থিরতা চলছে আশুলিয়ার রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে (ইপিজেড)। বিএনপি ও তাদের সহযোগী সংগঠনের নাম ব্যবহার করে এরই মধ্যে তিনটি বাহিনী ইপিজেডকেন্দ্রিক ঝুট ব্যবসার দখল নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর স্থানীয় কয়েকজন নেতা ও তাদের ক্যাডার বাহিনী অন্তত ৫০টি কারখানা দখলের চেষ্টা করায় অস্থিরতার ঘটনা ঘটেছে। দখল করতে গিয়ে ইপিজেডের মধ্যেই দুই বাহিনী সংঘর্ষে জড়িয়েছে। এসব অপকর্মে বিএনপির শীর্ষস্থানীয় কেন্দ্রীয় নেতাদের নামও ব্যবহার করা হচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ৫ আগস্টের পর ইপিজেডের ঝুট ব্যবসা দখলে নিতে প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন ফ্যাক্টরিতে যাচ্ছে সাবেক সংসদ সদস্য ডা. দেওয়ান মো. সালাউদ্দীন বাবু গ্রুপ, সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল গফুর গ্রুপ ও আইয়ুব খান গ্রুপ। এক গ্রুপ আরেক গ্রুপকে ঠেকাতে কারখানা থেকে বহির্গামী মালবাহী গাড়িগুলো আটকে দিচ্ছে। নিজেদের মধ্যে একাধিকবার সংঘর্ষ, হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটিয়েছে।
সালাউদ্দীন বাবু বাহিনী: অভিযোগ উঠেছে, ইপিজেডে দখলবাজি ও অস্থিরতায় এগিয়ে আছেন সাবেক সংসদ সদস্য ডা. দেওয়ান মো. সালাউদ্দীন বাবু। তার পক্ষে নেতৃত্ব দিচ্ছেন ব্যক্তিগত সহকারী শরিফুল ইসলাম। ৮ আগস্টের পর থেকে সাসা, সিকেডিএল, হোপলং, ওয়াইকেকে ও শান্তা নামক ফ্যাক্টরিতে বিশৃঙ্খলা, হুমকি, মালপত্র আটকে দেওয়ার ঘটনা ঘটিয়েছেন তিনি। এ ছাড়া অন্তত ৪০টি কারখানায় সরাসরি হস্তক্ষেপ করেছে বাবু বাহিনী।
ঝুট ব্যবসার দখলবাজিতে সালাউদ্দীন বাবু বিএনপির শীর্ষস্থানীয় এক নেতার নামও ব্যবহার করেছেন। ওয়াইকেকে ফ্যাক্টরিতে ঝুট ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিতে পিএস শরিফুলের নেতৃত্বে ৫০ থেকে ৬০ জন যায় ওই কারখানায়। সেখানে গিয়ে শরিফুল বিএনপির শীর্ষস্থানীয় ওই নেতার এলাকার ভাইকে কাজ দিতে বলেছেন বলে জানান। কারখানার কর্মকর্তাদের বলেন, এজন্য বস (সালাউদ্দীন বাবু) আমাদের পাঠিয়েছেন।’
এ বিষয়ে ওয়াইকেকের এক কর্মকর্তা বিভিন্ন গ্রুপের অপতৎপরতার কথা স্বীকার করেন। ওই কর্মকর্তা বলেন, শুধু কেন্দ্রীয় নেতা নয়, একেবারে টপ নেতাদেরও নাম বলা হচ্ছে। আমরা জানি এগুলো মিথ্যা। এজন্য আমাদের ম্যানেজমেন্ট থেকে এগুলো পাত্তা না দিতে বলেছে। কিন্তু আমাদের নিজেদের ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে।
সালাউদ্দীন বাবুর এসব দখলদারিত্বে শরিফুলের নেতৃত্বে অন্তত ২০০ জনের একটি বাহিনী রয়েছে। তাদের মধ্যে অন্যতম মেহেদি মাসুম, আবু হানিফ, শাহিনুর রহমান শাহিন, মোস্তাফিজুর রহমান রনি, জাহাঙ্গীর মণ্ডল ও মামুন চৌধুরী।
অনেক চেষ্টা করেও এসব অভিযোগের বিষয়ে ডা. দেওয়ান মোহাম্মদ সালাউদ্দীন বাবুর বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তার চারটি মোবাইল নম্বরে একাধিকবার কল দেওয়া হয়। হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজও পাঠানো হয়; কিন্তু তিনি কোনোভাবেই সাড়া দেননি। একই সঙ্গে তার ব্যক্তিগত সহকারী শরিফুল ইসলামের নম্বরেও কল ও হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ দেওয়া হয়। তিনিও সাড়া দেননি। জানা যায়, এসব অভিযোগ ওঠার পর গণমাধ্যমকর্মীদের এড়িয়ে চলছেন তিনি।
আইয়ুব বাহিনী:
আশুলিয়া ইপিজেড অস্থিরতায় ভূমিকা রাখছে আরেক প্রভাবশালী গ্রুপ আইয়ুব বাহিনী। ইপিজেডের অন্যতম একটি কারখানা শান্ত ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। ওই কারখানার ঝুট ব্যবসার চুক্তি রয়েছে মিজান নামের এক ব্যক্তির সঙ্গে। সরকার পরিবর্তনের পর মিজানের কারখানায় যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে আইয়ুব খানের বাহিনী। গত ২০ আগস্ট ওই কারখানা থেকে ঝুটের গাড়ি বের করার চেষ্টা করে মিজানের কর্মচারীরা। কিন্তু সেখানে সালাউদ্দীন বাবুর পিএস শরিফুল ইসলামের নেতৃত্বে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তিন শতাধিক ক্যাডার সেই মালের গাড়ি ইপিজেডের গেটে আটকে দেয়। একইভাবে আরও অন্তত আটটি কারখানায় অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে আইয়ুব বাহিনী। এর মধ্যে সাসাসহ কয়েকটি কারখানা দখলে আইয়ুব খান নিজেই গেছেন।
আইয়ুব বাহিনীর নেতৃত্ব দেন তার বিশ্বস্ত ক্যাডার আশুলিয়ার শীর্ষ সন্ত্রাসী টিপু (হাতকাটা টিপু)। বাহিনীর অন্যদের মধ্যে রয়েছে সাগর, তানিম, মিন্টু, লিটন, সাগর, পারভেজ, কামালসহ অন্তত ৪০ জন। তারা সাসা, সিকেডিএল, তালিসমা, প্যাডক্স, পেক্সার, হোপলং, ওয়াইকেকে, শান্তাসহ অন্তত ৪০টি কারখানায় প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করেছে।
গফুর বাহিনী:
ইপিজেডে দখলবাজিতে আরেক গ্রুপ হচ্ছে ধামসোনা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান অব্দুল গফুর। তিনি নিজে সরাসরি কোনো কারখানায় যান না। তার গ্রুপের নেতৃত্ব দিচ্ছেন সহোদর ছোট ভাই ও আওয়ামী লীগ নেতা ব্যারিস্টার মনির। ৫ আগস্টের পর থেকে মনিরের নেতৃত্বে ঝুট ব্যবসা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে বাক্সটার, ব্রেন্টন, চেরি, ইয়ংওয়ান, ঢাকারিয়া, এফসিআই, তালিসমা, প্যাডক্স ও পেক্সার কারখানায়। মনিরের সঙ্গে এই বাহিনীর নেতা হিসেবে রয়েছেন তাদের বোনের স্বামী মিজানুর রহমান মিজান। মিজানের নেতৃত্বে ক্যাডার হিসেবে আলিম, সমির, ফারুক, সোহরাব, মাহবুব, শিমুল ও রুবেলসহ (ভাইগনা রুবেল) অন্তত ৫০ জনের বাহিনী ইপিজেডে বিভিন্ন দখলবাজিতে কাজ করছে।
এর মধ্যে রুবেলের নেতৃত্বে ইপিজেডের গেটে তিন ট্রাক মাল ছিনতাইয়ের ঘটনাও ঘটেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। আগস্টের শেষে ইয়াংঅন থেকে ঝুট বের করার সময় গেটে রুবেলসহ ২০ থেকে ৩০ জনের একটি বাহিনী ট্রাক তিনটি ছিনতাই করে নিয়ে যায়।
এ বিষয়ে আব্দুল গফুর বলেন, দখল করতে নয়, ইপিজেডে গন্ডগোল থামাতে গিয়েছিলেন তিনি। ওইদিন সেখানে শ্রমিকদের আন্দোলন হচ্ছিল। যেহেতু আমি ওই এলাকার সাবেক চেয়ারম্যান, তাই ইপিজেডের পরিচালক আমার কাছে সহায়তা চেয়েছিলেন। যেন শ্রমিকদের বুঝিয়ে তাদের আন্দোলন বন্ধ করতে সহায়তা করি। আমার লোকেরা সেই সহায়তাই করেছে।
ইপিজেডের মধ্যেই সংঘর্ষ:
গত ২৯ আগস্ট আব্দুল গফুরের ভাই ব্যারিস্টার মনিরের নেতৃত্বে ইপিজেডের হোপলং কারখানা দখলে নিতে যায় তার বাহিনীর ২০ থেকে ৩০ জনের একটি দল। কিন্তু ওই কারখানা আগে থেকেই দখলে নেওয়ার চেষ্টা করছিল সালাউদ্দীন বাবু গ্রুপ। গফুর বাহিনীর লোকজন যাচ্ছে খবর পেয়ে ছুটে যায় বাবু বাহিনী। বাহিনীর নেতৃত্ব দেয় জাহাঙ্গীর মণ্ডল। উভয় গ্রুপের দেখা হয় ইপিজেডের গেটে। গেটের মধ্যেই দুই গ্রুপের সংঘর্ষ শুরু হয়। এক পর্যায়ে গফুর বাহিনীর কয়েকজন আহত হলে তারা পিছিয়ে যায়। এতেও থামেনি গফুর বাহিনী। প্রতিশোধ নিতে পরদিন স্থানীয় বলিভদ্র বাজারে গিয়ে জাহাঙ্গীর মণ্ডলের মার্কেটে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করে। এর এক দিন পর আবারও বলিভদ্র বাজার তালপট্টি গ্রামে গিয়ে জাহাঙ্গীরের বাড়ি ও অফিসে হামলা চালায় গফুর বাহিনী। এসব হামলার সিসিটিভি ফুটেজ কালবেলার হাতে রয়েছে।
এ বিষয়ে আব্দুল গফুরের ছোট ভাই ব্যারিস্টার মনির বলেন, আমি একজন পেশাদার আইনজীবী। সারাদিন আদালতে ব্যস্ত থাকি। আমি থাকি রাজধানীর ধানমন্ডি। আমি ইপিজেডে যাব কোন কারণে। ওদিকে তো আমার যাওয়ার কোনো কথাই না। ইপিজেডে সংঘর্ষের বিষয়ে আমি কিছু জানি না। তিনি আরও বলেন, আমার ভাই গফুর চেয়ারম্যান। সেখানে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। আমিও বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। আমাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হয়তো এ ধরনের কথা ছড়িয়েছে।
এ বিষয়ে জাহাঙ্গীর মণ্ডল বলেন, আমরা সেখানে দখল করতে যাইনি; বরং গফুর চেয়ারম্যানের ভাই মনির ও তার লোকজন কারখানা দখল করতে গিয়েছিল। ওরাই ইপিজেডে তাণ্ডব চালিয়েছে। ব্যারিস্টার মনিরকে ‘ঝুট ব্যারিস্টার’ আখ্যা দিয়ে জাহাঙ্গীর মণ্ডল বলেন, সে নামেই ব্যারিস্টার। ঝুট ব্যবসাই তার মূল পেশা। তারা দুই ভাইই হাইব্রিড বিএনপি। প্রথমে মুরাদ জংয়ের সঙ্গে আঁতাত করে এসব দখল ও চাঁদাবাজি করেছে। মুরাদ জং চলে যাওয়ার পরপরই তাকে ছেড়ে ডা. এনামের সঙ্গে ভিড়েছে। এখন হাসিনা সরকারের পতনের সঙ্গে সঙ্গে বিএনপি সাজার চেষ্টা করছে। গত ১৫ বছরে তারা বিএনপির কোনো কর্মকাণ্ডে অংশ নেয়নি। আমার শক্তিশালী রাজনৈতিক অবস্থান দুর্বল করে নিজেদের বিএনপির বড় নেতা হিসেবে জাহির করার চেষ্টা করছে।