ঢাকা: ২০২২ সালের শেষ তিন মাসে বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণ নবায়নের মাধ্যমে নিয়মিত করার পরও ব্যাংক খাতে মূলধন পরিস্থিতির খুব একটা উন্নতি হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে- গত বছরের ডিসেম্বর শেষে সরকারি-বেসরকারি ১১ ব্যাংক মূলধন ঘাটতিতে আছে। এসব ব্যাংকের মূলধন ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩০ হাজার ৭০২ কোটি টাকা। এর মধ্যে অন্তত ছয়টি ব্যাংকের মূলধন ভিত্তির অনুপাত (সিএআর) ঋণাত্মক ধারায় নেমেছে। এ ছাড়া ঘাটতিতে থাকা বেশ কয়েকটি ব্যাংক বছরের পর বছর বড় ধরনের মূলধন ঘাটতি নিয়ে চলছে। এ ধরনের পরিস্থিতি ব্যাংকগুলোর আর্থিক পরিস্থিতির দুর্বলতা নির্দেশ করে। মূলত বিভিন্ন আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণেই ব্যাংকগুলোতে মূলধন সংকট দেখা দিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নানা ছাড় ও নিবিড় তদারকির পরও তাদের মূলধন পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না। অন্যদিকে কিস্তি পরিশোধে ছাড় আর ঋণ নবায়নের শর্ত শিথিলের সুযোগ নিয়ে অনেকে বছরের পর বছর ব্যাংকের টাকা ফেরত না দিয়েও খেলাপিমুক্ত থাকছেন।
আন্তর্জাতিক নীতিমালার আলোকে ব্যাংকগুলোকে মূলধন সংরক্ষণ করতে হয়। বাংলাদেশে বর্তমানে ব্যাসেল-৩ নীতিমালার আলোকে ব্যাংকের ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের ১০ শতাংশ অথবা ৪০০ কোটি টাকার মধ্যে যেটি বেশি সে পরিমাণ মূলধন রাখতে হচ্ছে। কোনো ব্যাংক এ পরিমাণ অর্থ সংরক্ষণে ব্যর্থ হলে মূলধন ঘাটতি হিসেবে
বিবেচনা করা হয়। নিয়মানুযায়ী, ব্যাংকের উদ্যোক্তাদের জোগান দেওয়া অর্থ ও মুনাফার একটি অংশ মূলধন হিসেবে সংরক্ষণ করা হয়। কোনো ব্যাংক মূলধনে ঘাটতি রেখে তার শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ দিতে পারে না। এ ছাড়া বিদেশি ব্যাংকগুলো কোনো স্থানীয় ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেন করার আগে ব্যাংকের মূলধন পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে থাকে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, বছরের পর বছর বেশ কয়েকটি ব্যাংকের মূলধন ঘাটতিতে থাকা পুরো খাতের জন্য খারাপ বার্তা। কারণ কোনো ব্যাংক মূলধন ঘাটতিতে থাকলে তার আর্থিক ভিত্তির দুর্বলতা প্রকাশ পায়। ফলে ওই ব্যাংকের ওপর গ্রাহকদের আস্থাও কমে যায়। এ ছাড়া অন্য দেশের ব্যাংকগুলোর সঙ্গে লেনদেনের ক্ষেত্রে তাদের অসুবিধার মুখে পড়তে হয়। তাই ব্যাংকগুলোর মূলধন ভিত্তিতে শক্তিশালী করার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংককে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের পরামর্শ দেন তিনি।
মহামারী করোনা পরিস্থিতি উন্নতি হওয়ার পরও এর দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব, দেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে সৃষ্ট বন্যায় ব্যাপক ক্ষতি এবং চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ২০২২ সালেও ঋণের কিস্তি পরিশোধে ছাড় সুবিধা অব্যাহত ছিল। এ বছরও ঋণের কিস্তির মাত্র ২৫-৫০ শতাংশ অর্থ পরিশোধ করেই খেলাপিমুক্ত থাকার সুযোগ পেয়েছেন ঋণগ্রহীতারা। এর পাশাপাশি শর্ত শিথিলের কারণে নামমাত্র জামানতে বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণ নবায়নের মাধ্যমে নিয়মিত করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২২ সালে ব্যাংক খাতে ২৯ হাজার ২৭৯ কোটি ৮২ লাখ টাকার ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়েছে। এর মধ্যে শেষ তিন মাসেই করা হয়েছে প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকা। অথচ ২০২১ সালের পুরো সময়ে পুনঃতফসিল করা ঋণের পরিমাণ ছিল মাত্র ১২ হাজার ৩৭৯ কোটি টাকা।
আর বিপুল পরিমাণ ঋণ পুনঃতফসিলের কারণে গত বছরের শেষ তিন মাসে কাগজ-কলমে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ খেলপি ঋণ কমেছে। এর পরিমাণ প্রায় ১৩ হাজার ৭৩৯ কোটি টাকা। তার পরও পুরো বছরের হিসাবে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ১৭ হাজার ৩৮৩ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে গত বছরের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার ৬৫৭ কোটি টাকা। শুধু পরিমাণের দিক থেকেই নয়, শতাংশ হিসাবেও এ সময়ে খেলাপি ঋণ বেড়েছে। ২০২১ সালে ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের হার ছিল ৭ দশমিক ৯৩ শতাংশ, যা গত বছর বেড়ে হয়েছে ৮ দশমিক ১৬ শতাংশ।
যে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ যত বেশি, ওই ব্যাংককে তত বেশি মূলধন রাখতে হয়। আর ডিসেম্বর শেষে মূলধন ঘাটতির তালিকায় থাকা ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের আধিক্য অত্যধিক বেশি রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, গত ডিসেম্বরে মূলধন ঘাটতির তালিকায় থাকা ব্যাংকগুলোর মধ্যে রয়েছে- রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের সোনালী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক ও রূপালী ব্যাংক। আর বিশেষায়িত খাতের বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক। এ ছাড়া বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংক, আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক ও পদ্মা ব্যাংক মূলধন ঘাটতিতে আছে। আগের তিন মাসেও এই ১১ ব্যাংক মূলধন ঘাটতিতে ছিল। ওই সময় ব্যাংকগুলোর ঘাটতির পরিমাণ ছিল আরও বেশি, প্রায় ৩২ হাজার ৬০৬ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, গত ডিসেম্বরে সবচেয়ে বেশি ১৩ হাজার ৬৩২ কোটি টাকার মূলধন ঘাটতি রয়েছে বিশেষায়িত খাতের বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকে। এ খাতের রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের ঘাটতি রয়েছে ২ হাজার ২৬১ কোটি টাকা। রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের ব্যাংকগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ ঘাটতি অগ্রণী ব্যাংকের ৩ হাজার ৭৩৯ কোটি টাকা। এ ছাড়া সোনালী, জনতা, বেসিক ও রূপালী ব্যাংকের ঘাটতি যথাক্রমে ১ হাজার ৮৩২ কোটি, ১ হাজার ৫০০ কোটি, ২ হাজার ৩০৪ কোটি ও ২ হাজার ১০৭ কোটি টাকা। বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ ১ হাজার ৬৮০ কোটি টাকা ঘাটতি আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের। এ ছাড়া বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ১ হাজার ১৪৪ কোটি, ন্যাশনাল ব্যাংকের ১৮৪ কোটি ও পদ্মা ব্যাংকের ৩১৫ কোটি টাকা ঘাটতি রয়েছে।
প্রাপ্ত তথ্যে আরও দেখা যায়, বছরের শেষ তিন মাসে কাগজ-কলমে খেলাপি ঋণ কমানোর কারণে সার্বিক ব্যাংক খাতে মূলধন ভিত্তির সামান্য উন্নতি হয়েছে। এ সময়ে মূলধন পর্যাপ্ততা অনুপাত (সিএআর) দাঁড়িয়েছে ১১ দশমিক ৮৩ শতাংশ, যা গত সেপ্টেম্বরে ছিল ১১ দশমিক ০১ শতাংশ। আর ২০২১ সালের ডিসেম্বরে ছিল ১১ দশমিক ০৮ শতাংশ। যদিও এ সময়ে বেশ কয়েকটি ব্যাংকের সিএআর অনুপাত ঋণাত্মক ধারায় নেমে গেছে। এর মধ্যে বেসিক ব্যাংকের ঋণাত্মক ২ দশমিক ৩৪ শতাংশ, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ঋণাত্মক ২০ দশমিক ৪০ শতাংশ, আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের ঋণাত্মক ১৩৮ দশমিক ৩৪ শতাংশ, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের ঋণাত্মক ৫১ দশমিক ৪১ শতাংশ ও রাকাবের ঋণাত্মক ২৭ দশমিক ৬৯ শতাংশ। এ ছাড়া একই সময়ে বেশ কয়েকটি ব্যাংকের সিএআর ১০ শতাংশের নিচে রয়েছে। এ তালিকায় আছে- অগ্রণী, জনতা, সোনালী, রূপালী, ন্যাশনাল ও পদ্মা ব্যাংক।
বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের মূলধন ভিত্তি দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশের তুলনায়ও দুর্বল। বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২১ সালে পাকিস্তান, শ্রীলংকা ও ভারতের সিএআর অনুপাত ছিল যথাক্রমে ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ, ১৬ দশমিক ৫ শতাংশ ও ১৬ দশমিক ৬ শতাংশ। সেখানে বাংলাদেশের ২০২২ সালেও ১১ শতাংশের ঘরেই আটকে আছে।