ঢাকা: সারাদেশে ২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালে দুর্ঘটনার হার ২৯ শতাংশ বেড়েছে বলে জানিয়েছে নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা)। ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সারাদেশে সড়ক, নৌ ও রেলপথে মোট ৭ হাজার ২৪টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এর আগের বছর ২০২১ সালে ঘটেছে ৪ হাজার ৯৮৩টি। অর্থাৎ ২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালে দুর্ঘটনা বেড়েছে ২ হাজার ৪১টি।
বুধবার (৪ জানুয়ারি) জাতীয় প্রেসক্লাবের মাওলানা আকরাম খাঁ হলে ২০২২ সালের সড়ক দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান উপস্থাপন বিষয়ক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানায় নিচসা।
সংবাদ সম্মেলনে ২০২২ সালের সড়ক দুর্ঘটনা বিষয়ক প্রতিবেদন তুলে ধরেন নিসচার চেয়ারম্যান অভিনেতা ইলিয়াস কাঞ্চন। তিনি জানান, ১১টি জাতীয় দৈনিক ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া, অনলাইন মিডিয়া, শাখা সংগঠনের প্রতিবেদন, অনুমেয় অনুজ্জ বা অপ্রকাশিত ঘটনার ভিত্তিতে এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সারাদেশে সড়ক, নৌ ও রেলপথে দুর্ঘটনা ঘটেছে ৭ হাজার ২৪টি। এর মধ্যে সড়ক পথে ঘঠেছে ৫ হাজার ৭০টি, নৌ পথে ঘটেছে ৭৭টি, রেলপথে ঘঠেছে ২৫৬টি এবং অপ্রকাশিত তথ্য ও হাসপাতালে ভর্তির পর এবং হাসপাতাল থেকে রিলিজের পর মৃত্যু (আনুমানিক ৩০ শতাংশ) ঘটেছে ১ হাজার ৬২১টি।
এসব দুর্ঘটনায় মোট নিহত হয়েছেন ৮ হাজার ১০৪ জন এবং আহত হয়েছেন ৯ হাজার ৭৮৩ জন। এর মধ্যে সড়ক পথে মারা গেছেন ৫ হাজার ৭৬০ জন, আহত হয়েছেন ৭ হাজার ৩৩১ জন। রেলপথে মারা গেছেন ২৭০ জন, আহত হয়েছেন ৫১ জন৷ নৌ-পথে মারা গেছেন ২০৪ জন, আহত হয়েছেন ১৪৪ জন এবং নিখোঁজ রয়েছেন ১৮৬ জন। অপ্রকাশিত তথ্য ও হাসপাতালে ভর্তির পর এবং হাসপাতাল থেকে রিলিজের পর নিহত হয়েছে (আনুমানিক ৩০ শতাংশ) ১ হাজার ৮৭০ জন, আহত হয়েছেন ২ হাজার ২৫৭ জন।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, সড়ক, নৌ ও রেলপথে দুর্ঘটনায় নিহতদের মধ্যে পুরুষ ছিলেন ৫ হাজার ২৪২ জন এবং নারী ছিলেন ৯৯২ জন। পুরুষ আহত হয়েছেন ৬ হাজার ৩২ জন এবং নারী আহত হয়েছেন ১ হাজার ৪৯৪ জন।
এছাড়া যানবাহনের ধরণ অনুযায়ী চালক ও চালকের সহকারী নিহত হয়েছেন ২ হাজার ১৮৮ জন।
এসব দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে নিসচা জানায়, সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও মনিটরিং-এর অভাব, টাস্কফোর্স কর্তৃক প্রদত্ত ১১১টি সুপারিশনামা বাস্তবায়ন না হওয়া, চালকদের মধ্যে প্রতিযোগিতা ও বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালানোর প্রবণতা, দৈনিক চুক্তিভিত্তিক গাড়ি চালনা করা, লাইসেন্স ছাড়া চালক নিয়োগ, মোটরসাইকেল চালকদের বেপরোয়া চালানো এবং মানসম্মত হেলমেট ব্যবহার না করা, সড়ক, মহাসড়ক ও গ্রামীণ সড়কে গতিসীমা নির্ধারণ না করা, চালকদের মাদকে আসক্তি, পথচারীদের মধ্যে সচেতনতার অভাব, বিপদজনক ওভারটেকিং ও ওভারলোডিং করা, বিরতি ছাড়াই দীর্ঘসময় ধরে গাড়ি চালনা, ফিটনেসবিহীন গাড়ি চালনা বন্ধে আইনের প্রয়োগ না থাকা, সড়ক ও মহাসড়কে বৈধ ও অবৈধ গাড়ি বৃদ্ধি (বিশেষ করে দুই চাকার যানবাহন), মহাসড়কের নির্মাণ ত্রুটি, একই রাস্তায় বিভিন্ন গতির যানবাহন চলাচল, রাস্তার পাশে হাটবাজার ও দোকানপাটের কারণে সড়কে দুর্ঘটনা বাড়ছে।
এছাড়াও সকল ধরণের যানবাহনে অশিক্ষিত ও অদক্ষ চালক, রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব, সড়ক পরিবহন আইন- ২০১৮ পুরোপুরি বাস্তবায়ন না হওয়া সড়ক দুর্ঘটনার মূল কারণ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে।
সড়ক দুর্ঘটনা রোধে বেশ কিছু সুপারিশমালা দিয়েছে নিসচা। সেগুলো হলো- সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ এর পুরোপুরি বাস্তবায়ন সংক্রান্ত জরুরি কার্যক্রম গ্রহণ করা, প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক নির্দেশিত ৬ দফা এবং ১১ দফা সম্বলিত টাস্ক ফোর্স কর্তৃক দাখিলকৃত ১১১টি সুপারিশনামা যত দ্রুত সম্ভব বাস্তবায়ন করা। সেইসাথে হাইওয়েতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য যোগাযোগ মন্ত্রণালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যৌথ তত্ত্বাবধানে উচ্চ পর্যায়ের মনিটরিং সেল গঠন করে তাদের মাধ্যমে আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার ও সিসি ক্যামেরার মাধ্যমে মহাসড়কের যাবতীয় বিষয়সমূহ মনিটরিং করা। করোনা নিয়ে সরকারিভাবে যেরকম প্রচার প্রচারণা চালানো হচ্ছে। একইভাবে সড়ক দুর্ঘটনা নিরসনে প্রচার প্রচারণা চালাতে হবে। বিভিন্ন মিডিয়া মাধ্যমে সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান প্রচারের যে ধারাবাহিকতা শুরু হয়েছে ব্যাপকভাবে তার ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হবে।
এছাড়া স্কুলের পাঠ্যক্রমে সড়ক দুর্ঘটনারোধের বিষয়সমূহ অন্তর্ভূক্ত করার যে ঘোষণা দেয়া হয়েছে তা অবশ্যই বাস্তবায়ন করতে হবে। ঢাকা রুট ফ্রান্সাইজ-এর যে পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে তা পুরোপুরি বাস্তবায়ন জরুরি। ট্রাফিক সিগন্যাল অমান্য করা, যত্র-তত্র গাড়ি পার্কিং করা, নির্দিষ্ট স্থান ব্যতিরেকে যেখানে-সেখানে যাত্রী উঠানো-নামানো, ওভার টেকিং করা, পাল্টা-পাল্টি ও বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো, অতিরিক্ত যাত্রী ও মাল বোঝাই করা, গাড়ীর ছাদে যাত্রী বহন করা, ওভার ব্রিজ কিংবা আন্ডারপাস বা জেব্রা ক্রসিং থাকা সত্ত্বেও সেগুলো ব্যবহার না করার প্রবণতাকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার মাধ্যমে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
ঢাকা-চট্টগ্রাম, সিলেট, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল মহাসড়কের মতো সকল মহাসড়ক এবং প্রধান সড়কে একমুখী চলাচলের সিদ্ধান্ত নিয়ে দীর্ঘ এবং উচ্চতাসম্পন্ন সড়ক বিভাজন তথা রোড ডিভাইডার-এর ব্যবস্থা করতে হবে। সকল মহাসড়ক এবং প্রধান সড়ককে অবশ্যই ন্যূনতম চার লেনে উন্নীত করতে হবে। মহাসড়কের পাশে হাটিকুমরুল-বনপাড়া মহাসড়কের মত দুপাশে ধীর গতির যানবাহন চলাচলের জন্য আলাদা সড়ক (সার্ভিস রোড) নির্মাণ করতে হবে। পথচারীদের নির্বিঘ্নে চলাচলের জন্য ফুটপথগুলো দখলমুক্ত করে যেখানে ফুটপাত নেই সেখানে ফুটপাত তৈরীর ব্যবস্থা করতে হবে এবং নিয়মিত মনিটরিংয়ের মাধ্যমে পুনরায় যেনো ফুটপাত দখল না হয় এ বিষয়ে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। সড়কের ত্রুটিগুলো অচিরেই দূর করতে হবে।
সুপারিশমালায় আরো বলা হয়, দেশের ৬৬ টি প্রাথমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে প্রশিক্ষণরত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সড়ক দুর্ঘটনারোধে করণীয় সম্পর্কিত যে প্রশিক্ষণ নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) এর নিজস্ব অর্থায়নে প্রদান করা হচ্ছে এবং এর মাধ্যমে প্রতিটি শিক্ষক তাদের স্কুলে গিয়ে ছাত্র-ছাত্রী, অভিভাবক ও স্থানীয় জনগণকে সচেতন করছে, একইভাবে ইমাম প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটসহ মাদ্রাসা শিক্ষক ও স্কুল-কলেজের শিক্ষকদেরকে সরকারি খরচে সড়ক দুর্ঘটনা রোধে করণীয় সম্পর্কিত প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে। যাতে তারা স্ব স্ব এলাকায় সড়ক দুর্ঘটনারোধে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে। সেইসাথে স্কুল কার্যক্রমের মধ্যে স্কাউট, গার্লস গাইড, ক্লাবের ইউনিটগুলোর মত প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে একটি রোড সেফটি ইউনিট গঠনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন।
সংবাদ সম্মেলনে আরো উপস্থিত ছিলেন নিসচার ভাইস চেয়ারম্যান সৈয়দ এহসানুল হক কামাল, মহাসচিব লিটন এরশাদ, উপদেষ্টা মো. হামিদ, ড. আইয়ুবুর রহমান খান, ব্র্যাকের প্রোগ্রাম ম্যানেজার এম খালিদ মাহমুদ, জিএইচএআই এর কান্ট্রি কোর্ডিনেটর ড. শরীফুল আলম, সিআইপিআরবি এর ডিরেক্টর ড. সেলিম মাহমুদ চৌধুরী প্রমুখ।