ঢাকা: ‘ঘাউরা’ বা ঘারুয়া মাছের কথা যতটা প্রবাদে শোনা যায়, ততটা বাজারে দেখা যায় না। নদী, খাল-বিল থেকে এ মাছ প্রায় বিলুপ্তই হয়ে গেছে। নামে সুপরিচিত এ মাছকে আবার পাতে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিয়েছেন বিজ্ঞানীরা।
শুধু ঘারুয়া মাছ নয়, বিলুপ্তপ্রায় আরও সাত প্রজাতির দেশি মাছের বাণিজ্যিক চাষ শুরু হচ্ছে। কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে এসব মাছের পোনা এ বছরই উৎপাদন করতে যাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। এ মাছগুলো হলো: কাজলি, কুর্শা, গাঙ ট্যাংরা, বাইলা, জারুয়া, বোল ও আঙরা।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএফআরআই) বিজ্ঞানীরা বলছেন, পোনা উৎপাদনের পর দেশীয় প্রজাতির এই মাছগুলো চাষাবাদের জন্য ছড়িয়ে দেয়া হবে সারা দেশে। এতে বাজারে সহজলভ্য হবে বিপন্ন তালিকায় থাকা এসব মাছ।
ইনস্টিটিউট সূত্রে জানা যায়, একসময় দেশের বিভিন্ন জলাশয়ে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যেত কাজলি, গাঙ ট্যাংরা, ঘারুয়া ও বাইলা। তবে জারুয়া, বোল, আঙরা ও কুর্শা মূলত তিস্তা নদীর মাছ।জলাশয় সংকোচন, পানি দূষণ এবং অতি আহরণের ফলে এসব মাছের বিচরণ ও প্রজননক্ষেত্র ধ্বংস হওয়ায় বর্তমানে এগুলো বাংলাদেশে বিপন্ন প্রজাতির তালিকায়। খাবার টেবিলে এগুলোকে ফিরিয়ে আনতে বেশ কিছুদিন ধরেই গবেষণা চলছে। এর ধারাবাহিকতায় এ বছরের মধ্যে মাছগুলোর কৃত্রিম প্রজনন-কৌশল উদ্ভাবনের চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছেন বিজ্ঞানীরা।
কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে ইতোমধ্যে বিলুপ্তপ্রায় ৩২ প্রজাতির দেশীয় মাছের পোনা উৎপাদনে সফলতা পেয়েছে বিএফআরআই। এগুলো হলো: পাবদা, গুলশা, ট্যাংরা, মাগুর, দেশি সরপুঁটি, জাতপুঁটি, ভেদা, গুতুম, খলিশা, গজার, ফলি, চিতল, মহাশোল, বৈরালি, ভাগনা, বাতাসি, পুঁইয়া, কালিলা, রাণী।
এসব মাছের প্রজনন ও চাষাবাদ-কৌশল উদ্ভাবনের নতুন সংযোজন হলো দারকিনা। এ মাছটি নিয়ে ২০২১ সালের শুরুতে গবেষণা চলে। গবেষণার ধারাবাহিকতায় গত মার্চ মাসের শেষ দিকে ময়মনসিংহে ইনস্টিটিউটের স্বাদুপানি কেন্দ্রে এ মাছের প্রজনন ও পোনা উৎপাদনে সফলতা এসেছে।
এ গবেষণা নিয়ে ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. আশিকুর রহমান বলেন, কৃত্রিম প্রজননের জন্য বিলুপ্তপ্রায় মাছ পুকুর, বিভিন্ন জলাশয়, হাওর-বাঁওড় কিংবা নদী থেকে সংগ্রহ করা হয়। এরপর দীর্ঘ গবেষণার ধারাবাহিকতায় একপর্যায়ে হরমোন ইনজেকন প্রয়োগ করা হয়। অক্সিজেন সরবরাহের জন্য ঝরনার মাধ্যমে পানির প্রবাহের ব্যবস্থা করা হয়।
ইনজেকশন দেয়ার নির্দিষ্ট সময় পর ডিম দেয়ার একপর্যায়ে ডিম থেকে রেণু বের হয়ে আসে। ডিম থেকে রেণু বের হওয়ার পর ৪৮-৭২ ঘণ্টা রাখতে হয়। এভাবে ডিম থেকে উৎপাদিত রেণু পোনাকে নার্সারি পুকুরে স্থানান্তর করা হয়। সেখান থেকেই প্রচুর পরিমাণ পোনা উৎপাদন করা হয়।
মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা জুলফিকার আলী জানান, দেশীয় মাছের প্রাপ্যতা কমে যাওয়ায় সংরক্ষণের জন্য লাইভ জিন ব্যাংক স্থাপন করা হয়েছে। যেসব মাছের হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে, সেগুলো সংগ্রহ করে লাইভ জিন ব্যাংকে রাখা হয়। পরে গবেষণা করা হয়।
তিনি বলেন, দেশে স্বাদু পানির ২৬০ প্রজাতির মাছের মধ্যে ১৪৩ প্রজাতির ছোট মাছ রয়েছে। এর মধ্যে বিলুপ্তপ্রায় মাছের সংখ্যা ৬৪টি। দারকিনাসহ ইতোমধ্যে ৩২ প্রজাতির দেশীয় মাছের পোনা কৃত্রিম প্রজননে উৎপাদন করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৯ প্রজাতির মাছ সারা দেশে চাষের আওতায় এসেছে। বাকিগুলো চাষের আওতায় আনাসহ বিলুপ্তপ্রায় মাছের পোনা উৎপাদন করতে গবেষণা চলছে।
খাবার টেবিলে ফিরছে ‘ঘাউরা’ মাছ
সম্প্রতি দারকিনা মাছের কৃত্রিম প্রজননে সাফল্য পাওয়া গবেষক দলের প্রধান ও বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. রবিউল আউয়াল বলেন, গবেষণায় দেখা যায়, দারকিনা মাছের পুষ্টিগুণ অন্যান্য ছোট মাছের তুলনায় অনেক বেশি থাকে। প্রতি ১০০ গ্রাম ভক্ষণযোগ্য মাছে ভিটামিন-এ ৬৬০ মাইক্রোগ্রাম আরএই, ক্যালসিয়াম ৮৯১ মিলি গ্রাম, আয়রন ১২ দশমিক শূন্য মিলিগ্রাম এবং জিংক ৪ মিলিগ্রাম পাওয়া যায়।
তিনি বলেন, ‘বাজারে দারকিনা মাছ খুব একটা চোখে পড়ে না। হঠাৎ পাওয়া গেলেও ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা কেজি দরে বিক্রয় হচ্ছে। মাছটির জিনপুল সংরক্ষণের মাধ্যমে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করতে এবং চাষের জন্য পোনার প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে এর কৃত্রিম প্রজনন, নার্সারি ব্যবস্থাপনা ও চাষ কলা-কৌশল উদ্ভাবন করা প্রয়োজন। এই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে গবেষণায় মাছটির প্রজনন ও পোনা উৎপাদনে সফলতা পাওয়া যায়। এ ছাড়া দেশীয় প্রজাতির সবগুলো ছোট মাছই অধিক পুষ্টিসমৃদ্ধ। ফলে সবগুলো মাছ খাবার টেবিলে ফেরাতে পারলেই আমাদের সার্থকতা।’
এ বিষয়ে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএফআরআই) মহাপরিচালক ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ বলেন,
‘দেশীয় প্রজাতির মাছগুলোতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, লৌহ ও আয়োডিনের মতো প্রয়োজনীয় খনিজ পদার্থ আছে। এগুলো শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করে এবং রক্তশূন্যতা, গলগণ্ড ও অন্ধত্বের মতো রোগ প্রতিরোধে সহায়তা করে।’
তিনি বলেন, ‘একসময় দেশের যেকোনো জলাশয় বিশেষ করে খাল-বিলের পাশ দিয়ে হেঁটে গেলে দেশীয় বিভিন্ন মাছ চোখে পড়ত। এ ছাড়া পুকুর, স্রোতযুক্ত জলধারা ও প্লাবনভূমিতে প্রচুর পরিমাণে দেখতে পাওয়া যেত। বর্তমানে বাংলাদেশে অনেক মাছ বিপন্নের তালিকায় রয়েছে।’
মহাপরিচালক আরও বলেন, কাজলি, কুর্শা, গাঙ ট্যাংরা, বাইলা, জারুয়া, বোল, আঙরা ও ঘারুয়া মাছ কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে এ বছরই পোনা উৎপাদন সম্ভব হবে। এ ছাড়া নতুন করে কৃত্রিম প্রজননে সাফল্য পাওয়া দারকিনার বিপুল পরিমাণ পোনা উৎপাদন করে আগামী এক বছরের মধ্যে সারা দেশে চাষাবাদের আওতায় আনতে চেষ্টা চলছে।
এ বছর ঢেলা, রাণী, বাতাসি, পিয়ালি, খলিশা ইত্যাদি মাছের ব্যাপক পোনা উৎপাদনের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। এতে এসব দেশীয় মাছের চাষাবাদে পোনাপ্রাপ্তি সহজ হবে এবং উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। গবেষণার মাধ্যমে পর্যায়ক্রমে সব দেশীয় মাছকে খাবারের পাতে ফিরিয়ে আনা হবে।
পরিসংখ্যান মতে, ২০০৮-০৯ সালে চাষের মাধ্যমে দেশীয় মাছের উৎপাদন ছিল ৬৭ হাজার টন। দেশীয় মাছের পোনা উৎপাদন ও চাষাবাদ প্রযুক্তি উদ্ভাবন হওয়ায় ২০২০-২১ সালে উৎপাদন চার গুণ বেড়ে আড়াই লাখ টনে উন্নীত হয়েছে।