গুম ও নির্যাতনের ঘটনায় শেখ হাসিনার বিচার চেয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দায়ের করেছেন জামায়াতে ইসলামী নেতা প্রয়াত দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মামলার সাক্ষী সুখরঞ্জন বালি।
বৃহস্পতিবার (২১ আগস্ট) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন শাখায় উপস্থিত হন তিনি।
এ বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের প্রসিকিউটর গাজী এমএইচ তামিম জানান, সুখরঞ্জন বালি চিফ প্রসিকিউটর অফিসে অভিযোগ দাখিল করতে এসেছেন। অভিযোগে বলা হয়েছে, তাকে অপহরণ করে আটকে রাখা হয়, গুম ও নির্যাতন করা হয় এবং দীর্ঘদিন ভারতের কারাগারে তাকে আটক রাখা হয়।
এ সময় সুখরঞ্জন বালির আইনজীবী বলেন, ২০১২ সালে ট্রাইব্যুনালে জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মামলা চলছিল। তখন এই সুখরঞ্জন বালিকে দেলাওয়ার হোসাইনের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য পিক করেছিল পিরোজপুর থেকে। তাকে সাক্ষী দেওয়ার নানাভাবে চাপ দিয়েছিল, লাঞ্ছনা করা হয়েছিল। সুখরঞ্জন বালি বলেছেন, তার ভাইকে যারা মেরেছিল তখন সেখানে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ছিলেন না।
সুখরঞ্জন বালী তার অভিযোগে বলেন, আমার ভাই বিশাবালীকে (বিশেশ্বর বালী) ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পাকিস্তানি সেনারা হত্যা করে। ওই ঘটনার প্রেক্ষিতে ২০১০ সালের জুলাই-আগস্ট মাসের দিকে তৎকালীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত কর্মকর্তা হেলাল উদ্দিন আমাকে পিরোজপুরের পাড়েরহাটের রাজলক্ষ্মী স্কুলে ডেকে ৭১-এ আমার ভাই বিশাবালীর হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে জানতে চায়। আমি তাকে প্রকৃত ঘটনা খুলে বলি। কিন্তু হেলাল উদ্দিন আমাকে আমার ভাইয়ের হত্যাকারী হিসাবে প্রকৃত হত্যাকারীদের নামের সঙ্গে মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর নামও বলতে বলে এবং তার বিরুদ্ধে ট্রাইবুনালে গিয়ে মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে বলে।
তিনি বলেন, আমি হেলাল সাহেবকে তখনই স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিই যে, সাঈদী হুজুর আমার ভাই বিশাবালী হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে কোনোভাবেই জড়িত ছিলেন না। সুতরাং তার বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু তদন্ত কর্মকর্তা হেলাল সাহেব আমাকে জোরপূর্বক রাজি করাতে সেখানেই আমাকে শারীরিক নির্যাতন করতে থাকে।
তারা সেখানে উপস্থিত হয়েই আমাকে নানা রকম চাপ ও হুমকি দিতে থাকেন। আমি সাক্ষ্য দিতে রাজি না হলে, আউয়াল ও মালেক সাহেব আমাকে হত্যার হুমকি দেয়। আমি তাদের হাত থেকে ছাড়া পেয়ে আত্মগোপনে চলে যাই। দীর্ঘদিন আমি বিভিন্ন বাড়িতে লুকিয়ে থাকি।
তিনি আরও বলেন, আমাকে করা নির্যাতনের অনেক দিন পর একদিন সাঈদী হুজুরের ছেলে মাসুদ সাঈদী আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং আমার ভাই বিশাবালী হত্যার প্রকৃত ঘটনা জানতে চান। আমি তাকে প্রকৃত ঘটনা খুলে বলি। তখন মাসুদ সাঈদী জানতে চান, এই সত্য ঘটনা আমি ট্রাইবুনালে এসে বলতে রাজি আছি কি-না? জবাবে আমি সম্মতি প্রকাশ করলে, জনাব মাসুদ সাঈদী আমার ভাইয়ের হত্যার প্রকৃত ঘটনা ট্রাইব্যুনালে এসে বলার জন্য অনুরোধ জানান। ৩ নভেম্বর ২০১২ সালে বিকালের দিকে ঢাকায় আসি এবং মাসুদ সাঈদীর সঙ্গে যোগাযোগ করি। তিনি আমাকে ৪ তারিখ ট্রাইব্যুনালে অ্যাডভোকেট মিজানুল ইসলামের কাছে নিয়ে যান। উনাকে আমি আমি সব খুলে বলি। এরপর ৫ নভেম্বর ২০১২ এর সকালে অ্যাডভোকেট মিজানুল ইসলামের অফিসে মাসুদ সাঈদী আমাকে নিয়ে যান। তখন অ্যাডভোকেট মিজানুল ইসলাম সাহেব আমাকে তার গাড়িতে করে ট্রাইব্যুনালের দিকে রওয়ানা দেন।
সুখরঞ্জনের আইনজীবী বলেন, সে সময় ট্রাইব্যুনালের প্রাঙ্গণ থেকে সুখরঞ্জন বালিকে সাদা পোশাকধারী পুলিশের সদস্যরা জোরপূর্বক তুলে একটি প্রাইভেট কারে উঠিয়ে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যান। তারপর তাকে একটা বদ্ধ রুমে প্রায় তিন মাস আটকে রাখা হয়। এরপর তাকে সেখান থেকে সীমান্তের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে ভারতের সীমান্তরক্ষীদের কাছে সুখরঞ্জন বালিকে হস্তান্তর করা হয়।
আইনজীবী আরও জানান, সুখরঞ্জন বালি জানিয়েছেন, পরে তিনি যে স্থানটি আবিষ্কার করেছিলেন তা হলো ভারতের কলকাতার বশিরহাট। সেখানে তাকে আটক রাখা হয়েছিল এবং দীর্ঘ পাঁচ বছর জেল জীবন কাটাতে হয়। পরে তিনি মুক্তি পান।
সুখরঞ্জন বালি অভিযোগ করেন, ওই সময়ে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে তাকে অপহরণ, আটক রাখা এবং শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হয়েছিল। তিনি মনে করেন, এ ঘটনায় আইনি প্রতিকার পাওয়ার তার অধিকার রয়েছে। তিনি প্রসিকিউশন অফিসে এ সংক্রান্ত পূর্ণ বিবরণসহ লিখিত অভিযোগপত্র জমা দিয়েছেন।