ঢাকা : ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি পেতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলকে (আইএমএফ) সন্তুষ্ট করার প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে সরকার। ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত শর্তপূরণের অগ্রগতির মূল্যায়ন মঞ্চে বসে আইএমএফ মিশনকে কোন ইস্যুতে কোন যৌক্তিক ব্যাখ্যা দেবে, তা ইতোমধ্যে চূড়ান্ত করা হয়েছে। একইভাবে সময়াবদ্ধ কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী যেসব ক্ষেত্রে অগ্রগতির শর্তপূরণ হয়েছে, সেটিও তুলে ধরা হবে। সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআরসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর মধ্যে অনুষ্ঠিত আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠকে এই অগ্রগতি নির্ধারণ ও প্রযোজ্য বিষয়ে যৌক্তিক ব্যাখ্যা নির্ধারণ করা হয়।
ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি ছাড়ের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে আগামীকাল ৪ অক্টোবর থেকে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠকে বসছে আইএমএফ মিশন। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সঙ্গে টানা ১৬ দিনের এই সিরিজ বৈঠক চলবে আগামী ১৯ অক্টোবর পর্যন্ত। এই মিশনে আইএমএফ প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেবেন বাংলাদেশে সংস্থাটির মিশনপ্রধান রাহুল আনন্দ। আইএমএফ মিশনের এই সফরে বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে বৈঠক করলেও বাংলাদেশের পক্ষে এসব বৈঠকের সমন্বয় করছে অর্থ মন্ত্রণালয়।
আইএমএফের ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তিতে প্রায় ৩৮টি শর্ত রয়েছে, যা ৪২ মাসের মধ্যে পূরণ করতে হবে। এর মধ্যে স্বল্পমেয়াদে চলতি বছরের জুন ও সেপ্টেম্বরের মধ্যে যেগুলো বাস্তবায়ন করতে হয় সেগুলোর বাস্তবায়ন পরিস্থিতি পর্যালোচনা করবে সংস্থাটি। এ ছাড়া ২০২৪ সালের জুনের মধ্যে যেসব শর্ত বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করেছে সরকার, সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য কী কী উদ্যোগ থাকছে, তা-ও পর্যালোচনা করে দেখবে সংস্থাটি। উল্লেখ্য, চলতি বছরের ৩০ জানুয়ারি ঋণের প্রথম কিস্তি ৪৭ কোটি ৬২ লাখ ডলার দিয়েছে আইএমএফ। পরবর্তী দ্বিতীয় কিস্তি আগামী নভেম্বরে দেওয়ার কথা রয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আশা করছেন, কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি তৈরি না হলে বাংলাদেশ আইএমএফ ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি পাওয়ার শতভাগ যোগ্য। সেটি সার্বিক অর্থনৈতিক মানদণ্ডেই হোক আর সংস্থাটির আরোপিত শর্তের মূল্যায়ন প্রশ্নেই হোক। এ বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা জানান, এবারের সফরে আইএমএফ মিশনের কাছে সবচেয়ে বড় আগ্রহের বিষয় থাকবে রিজার্ভ ও রাজস্ব পরিস্থিতি ইস্যুতে। এ ক্ষেত্রে আইএমএফএর মানদণ্ড অনুযায়ী রিজার্ভ ২৩.৪০ বিলিয়ন এবং রাজস্ব আয় প্রতিবছর ০.৫ শতাংশ হারে বৃদ্ধির সক্ষমতায় পিছিয়ে বটে। কিন্তু তার পরিমাণ খুব বেশি নয়। কোন প্রেক্ষাপটে কিছুটা পিছিয়ে, তা আমাদের মতো আইএমএফ প্রতিনিধিরাও ভালো করেই জানেন। তারা শুধু বাংলাদেশই নয়, দেশে দেশে বৈশ্বিক অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকের বিষয়েও তারা বেশ ওয়াকিবহাল। আইএমএফের বিপিএম ৬ মানদণ্ড অনুযায়ী ২৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার ২১.১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এ ক্ষেত্রে ঘাটতি ২.২৫ বিলিয়ন ডলার। আইএমএফকে সন্তুষ্ট করতে এই ঘাটতির ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংক। তারা দাবি করছে, বৈদেশিক লেনদেনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কোনো পেমেন্ট বকেয়া নেই। প্রতি দুই মাস অন্তর আমদানিজনিত সব বিল আকু পেমেন্টের মাধ্যমে সব ক্লিয়ার রেখেছে বাংলাদেশ। তা ছাড়া বৈদেশিক ঋণ পরিশোধেও কোনো কিস্তি বকেয়া রাখা হয়নি। যদিও নানা অজুহাতে চাইলেই এই আমদানি বিল ও ঋণের কিস্তি বকেয়া রেখে রিজার্ভ পরিস্থিতির উন্নতি ঘটানো যেত, যা করতে চায়নি বাংলাদেশ। বিষয়টি আইএমএফ খুব ভালোভাবেই ওয়াকিহাল রয়েছে।
রাজস্ব ইস্যুতে কী ধরনের ব্যাখ্যা দেওয়া হবে জানতে চাইলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, আইএমএফ মিশন শুধু রাজস্ব আদায়ে অগ্রগতিই দেখবে না। তারা আগের অর্থবছরগুলোর তুলনায় চলমান প্রবৃদ্ধিও পর্যালোচনা করবে। এ ক্ষেত্রে ২০২১-২২ এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরের রাজস্ব প্রবৃদ্ধি এবং লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রায় ০.৫ শতাংশ অতিরিক্ত রাজস্ব আদায়ে অগ্রগতি বিবেচনায় নেওয়া হবে। এ ক্ষেত্রে আমরা হিসাব-নিকাশ করে আইএমএফকে দেখাতে পারব, সবমিলিয়ে ৬ হাজার কোটি টাকার মতো ঘাটতি রয়েছে। আর কোন পরিস্থিতিতে এই ঘাটতি সেটি আইএমএফও ভালো করে জানে। এরপরও আমরা আইএমএফ মিশনকে জানাব, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতিতে বৈশ্বিকভাবেই ডলারের বাজারে অস্থিরতা চলছে। সেটি বাংলাদেশেও দারুণভাবে প্রভাব পড়েছে। বৈশ্বিকভাবে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতির কারণে আমদানিতে বাড়তি ডলার খরচ করতে হয়েছে। এতে রিজার্ভে যে নাজুক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তার সুরক্ষায় আমদানি নিয়ন্ত্রণের মতো পদক্ষেপে যেতে হয়েছে। এর ফলে একদিকে শুল্কজনিত রাজস্ব কমে গেছে। অন্যদিকে কাঁচামালের অভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে আয়কর ও ভ্যাটজনিত রাজস্ব আদায়ও কিছুটা কমেছে, যা এখন ক্রমাগত বাড়তে শুরু করেছে। আগামীতে আরও বাড়বে। ফলে শর্তানুযায়ী ০.৫ শতাংশ অতিরিক্ত রাজস্ব আদায় নিয়ে এবারের মূল্যায়নে আইএমএফ কঠোর হবে না।
এর বাইরে স্বল্পমেয়াদের অন্য শর্তগুলো বাংলাদেশ পূরণ করতে সক্ষম হয়েছে। এর মধ্যে মুদ্রা ও বিনিময় হারের সংস্কার, আর্থিক খাতের সংস্কার, জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত সংস্কার এবং সামষ্টিক কাঠামো সংস্কার। ২০২৬ সাল পর্যন্ত এসব সংস্কার কার্যক্রম চলমান থাকবে। এ ছাড়া আইএমএফ চায়, সরকার সঞ্চয়পত্রের সুদ খাতে খরচ কমিয়ে অগ্রাধিকার খাতে আরও বেশি অর্থ ব্যয় করুক। এ ক্ষেত্রে সরকার চলতি অর্থবছরের বাজেটেই সে কাজটি সম্পন্ন করেছে। অর্থাৎ গত অর্থবছরের তুলনায় সঞ্চয়পত্রের ঋণ লক্ষ্যমাত্রাতেই কমিয়ে ৫০ হাজার কোটি টাকা থেকে ১৮ হাজার কোটিতে নামিয়ে আনা হয়েছে। এ খাত থেকে এখন পর্যন্ত ঋণ নেওয়ার হারও খুব নগণ্য। আইএমএফের অন্যতম শর্তের মধ্যে ছিল পেট্রোলিয়াম জাতীয় পণ্যের দাম একটি নির্দিষ্ট সময় পরপর সমন্বয়ের একটি স্থায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করার, যা গত বছর ডিসেম্বরের মধ্যে এ কাজটি করার শর্ত ছিল। সেটি ইতোমধ্যে করেছে সরকার। ফলে বিগত সময়ে প্রতি মাসে পণ্যটির দাম সমন্বয় হয়েছে। তবে অক্টোবরে মূল্য সমন্বয় না করা হয়নি। সরকার এ ক্ষেত্রে আইএমএফকে বলবে, শর্তানুযায়ী দেশে সব সংস্কারই চলমান রয়েছে। তবে দেশে একটি জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে এই মূল্য সমন্বয়টি আগের নির্ধারিত দরেই অপরিবর্তিত থাকবে। তা ছাড়া যে দামটি এখন রয়েছে, তা আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। ট্রেজারি সিঙ্গেল অ্যাকাউন্ট বা সরকারি কোষাগারের অর্থ জমার একক ব্যাংক চালুর জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়কে একটি নীতি প্রণয়নের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। ২০২৩ সালের মধ্যে এই কাজটি করতে হবে। এর বাইরে বাংলাদেশ ব্যাংককে আগামী গত জুলাইয়ের মধ্যে একটি সুদহার করিডোর ব্যবস্থা গ্রহণের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে, যা ইতোমধ্যে বাস্তবায়ন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এ ছাড়া আইএমএফের শর্ত মেনে ইতোমধ্যে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে জিডিপির হিসাব প্রকাশ করছে। ব্যাংক কোম্পানি (সংশোধন) আইন ২০২০ এবং আর্থিক কোম্পানি আইন ২০২০ জাতীয় সংসদে উপস্থাপিত হয়েছে।