ঢাকা: দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন, বিতর্কে জড়িয়েছেন, দলে বিভক্তি সৃষ্টি করেছেন- ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের এমন মন্ত্রী-এমপিদের ছেঁটে ফেলার সিদ্ধান্ত হয়েছে। ইতোমধ্যে এদের অনেককে দলের পদ-পদবি থেকে বাদ নয়তো অব্যাহতি দেয়া হয়েছে।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বলতে গেলে দোরগোড়ায়। অতীতে অনেকের ক্ষেত্রেই সংসদ নির্বাচনে মনোনয়নের পুনরাবৃত্তি হয়নি। আসন্ন নির্বাচনেও তার ধারাবাহিকতা থাকবে। এদের অনেকে আর দলেও ফিরতে পারবেন না।
আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্লাহ বলেন, ‘দলের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে দল ও সরকার-সংশ্লিষ্ট সবার আমলনামা রয়েছে। কতিপয় সংসদ সদস্য আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছেন।
‘অনেকে নিজে বা আত্মীয়-স্বজন দুর্নীতিতে জড়িয়েছেন। অনেকে বয়সের কারণে রাজনীতিতে সময় দিতে পারছেন না। দলে বিশৃঙ্খলা তৈরি করেছেন। সে ক্ষেত্রে বর্তমান সংসদের শতাধিক এমপির ব্যাপারে যে কথা বলা হয়েছে, তা অমূলক নয়।
আওয়ামী লীগের সূত্রগুলো বলছে, নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় মন্ত্রী-এমপিদের অবস্থান যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। তাদের সার্বিক বিষয় নিয়ে চলছে তথ্যানুসন্ধান। আবার কাউকে কাউকে নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনেও (দুদক) তদন্ত চলছে। দুদকের অভিযোগ নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত এসব সংসদ সদস্যের কাউকেই আগামী নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন দেয়া হবে না।
ক্ষমতাসীন দলটির দায়িত্বশীল একাধিক নেতা জানান, বিতর্কের কারণে সমালোচিতদের অনেকের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। ওই তালিকায় সবশেষ সংযোজন সাবেক প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসান। ৩ আগস্ট তার নিজ এলাকা জামালপুরের সরিষাবাড়ী উপজেলা আওয়ামী লীগের কমিটিতেও তার স্থান হয়নি। এর মোধ্যমে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে তার শেষ দেখে ফেলছেন অনেকেই।
তথ্য প্রতিমন্ত্রী থাকার সময়ে নানা বিতর্কের মুখে ২০২১ সালের ৭ ডিসেম্বর পদত্যাগ করতে বাধ্য হন মুরাদ। এক অভিনেত্রীর সঙ্গে নোংরা ভাষায় কথোপকথনের অডিও টেপ প্রকাশ এবং বিএনপি নেতা তারেক রহমানের কন্যা জাইমা রহমানকে নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করেন তিনি। এসব ঘিরে ব্যাপক বিতর্কের জেরে মন্ত্রিত্ব ছাড়তে হয় তাকে, যদিও এখনও তিনি সংসদ সদস্য।
খন্দকার মোশাররফ হোসেন
ফরিদপুর-৩ আসন থেকে নির্বাচিত দুবারের এমপি খন্দকার মোশাররফ হোসেন আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন পাচ্ছেন না, এটা মোটামুটি নিশ্চিত। ফরিদপুরে তার ঘনিষ্ঠ লোকজনের ব্যাপক অর্থ পাচার, লুটপাট ও দুর্নীতির অভিযোগ গণমাধ্যমে বছর জুড়েই চাউর হয়েছে। এসব অভিযোগে তার সহকারী একান্ত সচিব, তার ভাই এবং ঘনিষ্ঠ কর্মীদেরও গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সাবেক এই মন্ত্রী নিজেও দীর্ঘদিন ধরে দেশের বাইরে অবস্থান করছেন।
হাজী সেলিম
পুরান ঢাকার এই সংসদ সদস্য দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ। কথা বলতে পারেন না। তাছাড়া ২০০৮ সালে একটি দুর্নীতি মামলার রায়ে ১৩ বছরের সাজা হয় তার। রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করলে ২০২১ সালের ৯ মার্চ হাইকোর্ট ১০ বছরের সাজা বহাল রাখে ও অন্য ধারায় তিন বছরের দণ্ড থেকে অব্যাহতি দেয়।
এছাড়া ২০২০ সালের ২৫ অক্টোবর রাজধানীর কলাবাগান থানা এলাকায় নৌবাহিনীর লেফটেন্যান্ট ওয়াসিফ আহমদ খানকে হাজী সেলিমের ছেলে ইরফান সেলিম ও তার লোকজন কিল-ঘুষি মারে এবং মেরে ফেলার হুমকি দেয়। পরে ইরফানকে তার বাসা থেকে অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার করা হয়।
হাবিবে মিল্লাত
হাবিবে মিল্লাত সিরাজগঞ্জ-১ আসন থেকে নির্বাচিত এমপি। ছিলেন ওই জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকও। কিন্তু দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা এবং দলে কোন্দল সৃষ্টির অভিযোগে ২০২০ সালের নভেম্বরে তাকে দল থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়।
হাবিবে মিল্লাত এখনও সংসদ সদস্য আছেন। তবে তার শক্তির বড় উৎস শ্বশুর সাবেক মন্ত্রী মোশাররফ হোসেনও নানা অভিযোগে দেশছাড়া। আওয়ামী লীগের এই পরিবারের ভবিষ্যৎ অন্ধকার দেখছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
পঙ্কজ দেবনাথ
বরিশাল-৪ আসন থেকে নির্বাচিত পঙ্কজ দেবনাথকে সম্প্রতি দলের সব পদ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। এখনও তিনি সংসদ সদস্য হিসেবে বহাল রয়েছেন। তবে আগামী নির্বাচনে এই আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়াটা তার জন্য কঠিন হবে। কেননা আঞ্চলিক রাজনীতিতে তিনি দলাদলিতে জড়িয়ে পড়েছেন। কেন্দ্রেও একজন প্রভাবশালী নেতা তার প্রচণ্ড বিরোধী।
জাহাঙ্গীর আলম
গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম দল থেকে দুইবার বহিষ্কার হয়েছেন। প্রথমবার বহিষ্কার হন বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করে। যাতে তার দলীয় পদ এবং মেয়র পদ দুটোই চলে যায়। দ্বিতীয় বার তাকে বহিষ্কার করা হয় গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর বিরোধিতা করায়।
হাল আমলে আবার দলীয় কর্মকাণ্ডে দেখা যাচ্ছে জাহাঙ্গীরকে। দলের একজন কেন্দ্রীয় নেতার আশীর্বাদও রয়েছে তার প্রতি। তবে যত যা-ই ঘটুক তাকে আর দলে নেয়া হচ্ছে না বলে দাবি করেছে দলীয় একাধিক সূত্র।
শওকত হাচানুর রিমন
বরগুনা-২ (বেতাগী-বামনা-পাথরঘাটা) আসনের সংসদ সদস্য শওকত হাচানুর রহমান রিমনের বিরুদ্ধে আছে জমি দখলের অভিযোগ। স্থানীয় এক বৃদ্ধ তার জমি দখলমুক্ত করে দেয়ার দাবিতে চলতি বছরের ১০ মার্চ বরগুনা জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সামনে জায়নামাজ বিছিয়ে অনশন করেন।
এ ছাড়া দলীয় নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষকে পিটিয়ে বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমে আলোচনায় আসেন রিমন। তার পরিবার মুক্তিযুদ্ধবিরোধী বলেও সমালোচনা রয়েছে নেতাকর্মীদের মধ্যে।
মাহবুবুর রহমান
পটুয়াখালী-৪ আসনের সংসদ সদস্য মহিব্বুর রহমানকে ‘রাতের ভোটের এমপি’ বলে বেফাঁস মন্তব্যের কারণে সাবেক পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী ও পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মাহবুবুর রহমান তালুকদারকে এ বছরের ২৫ মে দলের পদ থেকে সাময়িকভাবে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। এমন বক্তব্যের কারণে দলের নেতাকর্মীরা তার ওপর প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ, নাখোশ।
এ ছাড়া টাঙ্গাইল-২ আসনের (গোপালপুর-ভূঞাপুর) আসনের সংসদ সদস্য তানভীর হাসান ছোট মনিরের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী হামলা ও জোরপূর্বক জমি দখলচেষ্টার অভিযোগ রয়েছে।
গত বছরের ১৬ জুলাই কুমিল্লা-৪ আসনের (দেবীদ্বার) সংসদ সদস্য রাজী মোহাম্মদ ফখরুলের বিরুদ্ধে দেবীদ্বার উপজেলা চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদকে সংসদ ভবনের পুরনো এমপি হোস্টেলে মারধরের অভিযোগ ওঠে।
গত বছরের ১৬ সেপ্টেম্বর ডেমরা সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের এক দলিল লেখককে ঢাকা-৫ আসনের সংসদ সদস্য কাজী মনিরুল ইসলাম মনু মারধর করেন বলে অভিযোগ ওঠে।
দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তনাধীন আওয়ামী লীগের এমন নেতাদের মধ্যে রয়েছেন মোয়াজ্জেম হোসেন রতন, সামশুল হক চৌধুরী, ওমর ফারুক চৌধুরী, মাহফুজুর রহমান মিতা, নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন, নজরুল ইসলাম বাবু ও আবদুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব।
আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক অসীম কুমার উকিলের বিরুদ্ধেও দুদকে তদন্ত হয়েছে।