বৃষ্টি আর উজানের ঢলে উত্তর ও মধ্যাঞ্চলের কয়েক জেলায় বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। অবর্ণনীয় কষ্টে দিন কাটছে বানভাসি লাখো পরিবারের। বিভিন্ন অঞ্চলের নদনদীর পানি বাড়ছেই। ১০ জেলার বড় ৮ নদীর পানি বইছে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে। শুরু হয়েছে তীব্র নদীভাঙন। চরম দুর্ভোগে পড়েছে পানিবন্দি মানুষ। দিশেহারা ভাঙনকবলিত এলাকার বাসিন্দারাও। দুর্গত এলাকায় দেখা দিয়েছে ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাব।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী সরদার উদয় রায়হান জানান, বৃষ্টিপাতের কারণে উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নদনদীর পানি কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে। বৃহস্পতিবারের আগের তিন দিন বন্যা পরিস্থিতি মোটামুটি উন্নতি হয়েছিল। বৃহস্পতিবার থেকে পানি আবার অল্প পরিমাণে বেড়েছে। বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমে গেলে পানি আবারও স্বাভাবিক অবস্থায় চলে আসবে। শুক্রবার যেহেতু বৃষ্টি হয়েছে, আগামী ২৪ ঘণ্টায় পানি বাড়বে সামান্য। গত ২৪ ঘণ্টায় সিলেটের কানাইঘাটে সর্বোচ্চ ৪০ সেন্টিমিটার ও চিলমারী পয়েন্টে ১২ সেন্টিমিটার পর্যন্ত পানি বেড়েছে।
গতকাল রাজধানীসহ সারা দেশেই বৃষ্টি হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হয়েছে চট্টগ্রামের সন্দ্বীপে ১৮৮ মিলিমিটার। এ ছাড়া রাজশাহীতে ১৩৫, ঢাকায় ১৩১, টাঙ্গাইলে ১০৮, ফেনী ও কুষ্টিয়ায় ১০২ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে।
আবহাওয়া অফিস জানায়, মৌসুমি বায়ু এখন অতিমাত্রায় সক্রিয় থাকার কারণেই এই ভারি বৃষ্টি হচ্ছে। এই মৌসুমি বায়ুর অক্ষ ভারতের পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তর প্রদেশ, বিহার,
পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ এবং ভারতের আসাম হয়ে উত্তর বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে। বাংলাদেশ ও বঙ্গোপসাগরে মৌসুমি বায়ু অতিমাত্রায় সক্রিয় থাকায় উপকূলীয় এলাকায় অতি ভারি বৃষ্টি হয়েছে। দেশের ঢাকা, রংপুর, রাজশাহী, খুলনা ও বরিশাল অঞ্চলে বৃষ্টির পরিমাণ বেড়ে চলেছে।
মৌসুমি বায়ুর সক্রিয়তা আরও অন্তত তিন থেকে পাঁচ দিন পর্যন্ত থাকবে। তবে আজ শনিবার থেকে বৃষ্টির অতিমাত্রার সক্রিয়তা কমে আসবে। এর ফলে আজ থেকে মাঝেমধ্যে হালকা আবার মাঝারি ধরনের বৃষ্টি হলেও এমন ভারি বর্ষণ হবে না বলে আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে। আজ রংপুর, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের অধিকাংশ জায়গায় এবং ঢাকা, রাজশাহী, খুলনা ও বরিশাল বিভাগের অনেক জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি/বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। সেইসঙ্গে রংপুর, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের ভারি থেকে অতি ভারি বর্ষণ হতে পারে।
ভারি বর্ষণ ও উজানের ঢলে জামালপুরে আবারও বাড়তে শুরু করেছে যমুনা নদীর পানি। প্রথম দফার বন্যার পানি নেমে যেতে না যেতেই ফের বাড়তে শুরু করেছে। এতে দুর্ভোগ বেড়েছে বানভাসিদের। জানা গেছে, ইসলামপুরের চিনাডুলী, কুলকান্দি, নোয়ারপাড়া, বেলগাছা, সাপধরী ইউনিয়ন এবং দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার চুকাইবাড়ী, চিকাজানী, বাহাদুরাবাদ ইউনিয়ন ও পৌরসভার উঁচু এলাকা থেকে পানি নেমে গেলেও ফের কিছু কিছু জায়গায় আবার পানি উঠতে শুরু করেছে। ৬টি উপজেলার ৪১টি ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চলের ৩ লাখ মানুষ পানিবন্দি। বাড়িঘর ছেড়ে অনেকেই আশ্রয় নিয়েছে উঁচু জায়গা কিংবা আশ্রয়কেন্দ্রে। প্রত্যন্ত এলাকাগুলোতে ত্রাণ সহায়তা না পৌঁছানোর অভিযোগ রয়েছে। ছড়াচ্ছে চর্মরোগসহ বিভিন্ন রোগবালাই।
সুনামগঞ্জে সবক’টি নদনদীতে রাতে পানি বাড়লেও তা দিনে কমতে শুরু করেছে। তবে রাতের পানিতে শহরের সাহেববাড়ি ঘাট, বাজার এলাকা ও লঞ্চঘাট প্লাবিত হয়েছে। ভারতের মেঘালয় এবং সুনামগঞ্জে ভারি বর্ষণের কারণে নদনদীতে পানি বেড়েছে। দোয়ারাবাজার, ছাতক, সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার সীমান্ত ও নদীতীরবর্তী এলাকার রাস্তাঘাট তলিয়ে গেছে। সেইসঙ্গে জেলা শহরের বেশ কিছু এলাকা প্লাবিত হয়েছে।
তিন দিন মন্থর গতিতে কমতে থাকার পর সিরাজগঞ্জে যমুনা নদীর পানি আবারও বাড়তে শুরু করেছে। এদিকে যমুনার অভ্যন্তরীণ চরাঞ্চলে বন্যায় প্রায় এক লাখেরও বেশি মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে। বন্যার পানিতে ডুবে এখন পর্যন্ত জেলায় ৮ জন মানুষের মৃত্যু হয়েছে। সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী নাজমুল হোসেন বলেন, আজকেও যমুনা নদীর পানি কিছুটা বাড়তে পারে। তবে আগামীকাল থেকে কমে যাবে। চলতি মাসে এ অঞ্চলে বন্যার কোনো সম্ভাবনা নেই।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. আক্তারুজ্জামান জানান, জেলার ৫টি উপজেলার ৩৪টি ইউনিয়নে ২৩ হাজার ৩০৬টি পরিবারের এক লাখ ৩ হাজার ৫৯৪ জন মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বন্যাদুর্গত এসব মানুষের মধ্যে ইতোমধ্যে ১৩৩ মেট্রিক টন চাল, ৫ লাখ টাকা ও ৩০০ প্যাকেট শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে। মজুত রয়েছে ১ হাজার ১৬৭ মেট্রিক টন চাল, ২০ লাখ টাকা ও ৭০০ প্যাকেট শুকনো খাবার। চলতি বন্যায় জেলার সদর, শাহজাদপুর ও চৌহালীতে ৮ জন মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে নৌকা ডুবে ৪ জন ও পানিতে ডুবে আরও ৪ জন মারা গেছেন।
কুড়িগ্রামের বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হলেও কমেনি মানুষের দুর্ভোগ। বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে ও উঁচু স্থানে আশ্রয় নেওয়া অনেক বানভাসি এখনো তাদের নিজ নিজ ঘরে ফিরতে পারেনি। চলতি দুই দফা বন্যায় জেলার ৯ উপজেলার ৫৫টি ইউনিয়নের আড়াই লক্ষাধিক মানুষ এখনো পানিবন্দি। উলিপুর উপজেলার হাতিয়া ইউনিয়নের দুর্গম চর এলাকার চরগুজিমারির বাসিন্দা মোতালেব হোসেন জানান, হার্টের সমস্যা নিয়ে প্রায় ১১ দিন ধরে পানিবন্দি রয়েছি। এখন পর্যন্ত কেউ কোনো ত্রাণ দিতে আসেনি। পরিবারের ৪ সদস্যকে নিয়ে শুকনো জায়গায় যাদের বাড়ি সেখানে গিয়ে কিংবা নৌকায় রান্নাবান্না করে কষ্টের মধ্য দিয়ে চলছি।
অন্যদিকে, তিস্তা নদীর পাড়ের ঘড়িয়ালডাঙা ইউনিয়নে তৈয়বখাঁ ও পাড়া মৌলায় নদীভাঙন প্রকট আকার ধারণ করেছে। এ ছাড়া ধরলা নদীর সদরের হলোখানা ইউনিয়নের সারডোব এলাকায় নদীতে ঘরবাড়ি ও স্থাপনা ভাঙনে চলে যাচ্ছে।
গাইবান্ধায় আবারও বাড়ছে নদনদীর পানি। বন্যা পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হলেও আবারও ব্রহ্মপুত্র, ঘাঘট ও তিস্তা নদীর পানি বাড়ছে। ব্রহ্মপুত্র নদের পানি এখনো বিপৎসীমার ৩৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এ ছাড়া ঘাঘটের পানি বিপৎসীমার ১১ সেন্টিমিটার ও তিস্তার পানি বিপৎসীমার ৬৩ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে আবারও লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। পানিবন্দি এসব এলাকার মানুষ শিশু-বৃদ্ধ ও গবাদি পশু নিয়ে বিপাকে পড়েছেন।
বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে পাট, ভুট্টা, আউশ ধান, আমন বীজতলাসহ আড়াই হাজার হেক্টরের অধিক জমির ফসল। ভেসে গেছে পুকুর ও মাছের ঘের। দ্রুত সরকারি সহযোগিতা চাচ্ছে জেলার সদর, সাঘাটা, ফুলছড়ি ও সুন্দরগঞ্জের ৪ উপজেলার লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। তারা প্রকট সংকটে পড়েছে শুকনো খাবার, গো-খাদ্যসহ বিশুদ্ধ পানির।
টাঙ্গাইলে সব নদীর পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়েছে তীব্র নদীভাঙন। জেলার ভূঞাপুর, বাসাইল, দেলদুয়ার ও নাগরপুর উপজেলার ১৫টি ইউনিয়নের শতাধিক গ্রামের নদীতীরবর্তী এলাকার বাড়িঘর, হাট-বাজার, ফসলি জমি, রাস্তা, কবরস্থান, মসজিদসহ অনেক স্থাপনা বিলীন হয়ে গেছে। ফলে বন্যা ও ভাঙনে নদীপাড়ের মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়েছে। তাদের দাবি, জরুরিভাবে নদীভাঙন রোধ করা হোক এবং বন্যার্তদের সরকারি সহায়তা করা হোক।