ঢাকা: স্ত্রীর টিউমার অপারেশনের টাকা উত্তোলনের জন্য ডাচ-বাংলা ব্যাংকের এটিএম বুথে গিয়েছিলেন ৬০ বছর বয়সী আতাউর রহমান। এটিএম মেশিনে কার্ড ঢোকানোর পর কাজ হচ্ছিল না। তখন সহযোগিতার জন্য এগিয়ে আসে এক ব্যক্তি; কিন্তু এটি ছিল ফাঁদ। ওই ব্যক্তি চোখের পলকে পাল্টে দেয় আতাউরের এটিএম কার্ড। পরিবর্তিত কার্ড যখন এটিএম মেশিনে ঢোকানো হয়, তখন তা আটকে যায়। কার্ড মেশিনে আটকে গেছে দেখে ফেরত আসেন আতাউর। কিছু সময় পরই তার অ্যাকাউন্ট থেকে এক লাখ টাকা উত্তোলনের মেসেজ আসে।
মেসেজ দেখে আতাউর ব্যাংকে যোগাযোগ করেন। ব্যাংক থেকে জানানো হয়, তার এটিএম কার্ড ব্যবহার করে পাঁচবারে এক লাখ টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। এ ঘটনায় তিনি শাহবাগ থানায় একটি অভিযোগ করেন। এরপর ঘটনার তদন্ত শুরু করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগ। তারা জানতে পারে, ডাচ-বাংলা ব্যাংকের বিভিন্ন বুথের ভেতরে ও বাইরে অবস্থান নিয়ে একাধিক ব্যক্তির সহযোগিতায় কার্ড বদল করে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার কাজটি করছে শহিদুল ইসলাম শহিদ নামে এক ব্যক্তি।
গত বুধবার রাজধানীর একটি আবাসিক হোটেল থেকে শহিদ ও তার সহযোগী মামুন মাতব্বরকে গ্রেপ্তার করে ডিবির সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগ। তাদের কাছ থেকে ডাচ-বাংলার দুটি এটিএম কার্ড উদ্ধার করা হয়। ডিবি টাকা উত্তোলনের সময় ব্যাংক কর্মকর্তা বা পরিচিত ব্যক্তি ব্যতীত অজ্ঞাত কারও সহযোগিতা না নেওয়া ও নিজের এটিএম কার্ড অপরিচিত কারও কাছে না দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
ডিবির সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. জুনায়েদ আলম সরকার বলেন, যেসব বুথে সিকিউরিটি গার্ড অন্যমনস্ক বা অনুপস্থিত থাকে, সেখানে শহিদ টাকা ওঠানোর বাহানা করে বুথের ভেতরে অবস্থান করে। সে সঙ্গে দুটি ভিন্ন রঙের ডাচ-বাংলার কার্ড রাখে। বাইরে তার সহযোগী মামুন আশপাশে নজর রাখে। টাকা উঠানোর জন্য কোনো বয়স্ক ব্যক্তি বা নারী এটিএম বুথে প্রবেশ করলে তাকে টার্গেট করে ফাঁদ পাতে।
শহিদ নির্ধারিত একটি এটিএম মেশিনের মোবাইল ব্যাংকিংয়ের (রকেট) মাধ্যমে টাকা উত্তোলন অপশন চালু করে রাখে। অন্য মেশিনগুলোতে সমস্যা হচ্ছে জানিয়ে টার্গেট করা গ্রাহককে নির্ধারিত (যেটায় রকেটে লেনদেন চালু) মেশিনে যেতে বলে। গ্রাহক ওই নির্ধারিত এটিএম মেশিনে কার্ড প্রবেশ করান; কিন্তু রকেট অপশন চালু থাকায় এটিএম কার্ড দিয়ে ওই মেশিন থেকে টাকা উত্তোলন করা সম্ভব হয় না। তখন সহযোগিতা করার নাম করে এগিয়ে আসে শহিদ। সরল বিশ্বাসে গ্রাহক শহিদের কাছে কার্ড দিলে চোখের পলকে তা পাল্টে নিজের কাছে থাকা কার্ড দিয়ে দেয়। গ্রাহক বুঝতে না পেরে ওই কার্ড যখন আবারও এটিএম মেশিনে প্রবেশ করান, তখন দূর থেকে গ্রাহকের আঙুলের নড়াচড়ায় পিন নম্বরটি আয়ত্ত করে নেয় শহিদ। কিন্তু ততক্ষণে কার্ড এটিএম মেশিনে আটকে যায়। গ্রাহক উপায় না দেখে বেরিয়ে যাওয়ার পর শহিদ হাতিয়ে নেওয়া কার্ড ও পিন দিয়ে পার্শ্ববর্তী কোনো একটি বুথ থেকে দ্রুত টাকা তুলে নেয়।
শহিদের ফাঁদে পড়ে ৫০ হাজার টাকা খুইয়েছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. উম্মে আতিয়া। তিনি বলেন, আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির পাশে ডাচ-বাংলার এটিএম বুথে গিয়েছিলাম। বুথের ভেতরে আগে থেকেই একজন ছিল। শুরুতে আমার কার্ডে টাকা উঠাতে পারছিলাম না। তখন সাহায্য করার কথা বলে আমার কাছ থেকে কার্ডটি নেয়। কিছু বুঝে ওঠার আগেই কার্ডটি পাল্টে ফেলে। আমাকে তার কাছে থাকা একই ধরনের একটা কার্ড ধরিয়ে দেয়। আমি না বুঝে ওই কার্ডটি এটিএম মেশিনে ঢুকিয়ে আমার পিন নম্বর দেই। পরক্ষণেই কার্ডটি মেশিনে আটকে যায়। আমি বেরিয়ে গাড়িতে ওঠার পর আমার ফোনে মেসেজ আসে। তিনবারে ২০, ২০, ১০ হাজার করে ৫০ হাজার টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। পরে ব্যাংকে ফোন করে কার্ডটি বন্ধ করাই। দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রতারককে গ্রেপ্তার করায় ডিবির প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন ডা. আতিয়া।
জানা গেছে, আট বছরের বেশি সময় ধরে এই প্রক্রিয়ায় প্রতারণা করে আসছে শহিদ। ডিএমপি ডিবির প্রধান অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, শহিদ ২০১৫ সাল থেকে এককভাবে কার্ড বদলের মাধ্যমে প্রতারণা করে আসছে। ডাচ-বাংলা ব্যাংকের এটিএম বুথে টাকা তুলতে আসা মহিলা ও বৃদ্ধ লোকদের সে টার্গেট করে। এই অপরাধে শহিদ চারবার পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছে। জামিনে বের হয়ে ফের একই অপরাধে জড়ায়। প্রতিমাসে পাঁচ থেকে ছয়টি করে কার্ড অদল-বদল করে ২ থেকে ৩ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়। শহিদ স্থায়ীভাবে কোথাও থাকে না। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন বিভাগীয় শহরে আবাসিক হোটেলে অবস্থান করে বুথে এই প্রতারণা করে সে।