সিলেটের পর্যটন কেন্দ্র গুলোতে মৃত্যুর মিছিল থামছে না

আমাদের সময় ডেস্ক
  • আপডেট সময় বুধবার, ৩০ আগস্ট, ২০২৩

সিলেট: সিলেটের পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে মৃত্যুর মিছিল থামছেই না। এখানকার বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্রে ঘুরতে আসা পর্যটকদের প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে হরহামেশাই। আর তাদের বেশিরভাগেরই মৃত্যু হচ্ছে পানিতে সাঁতার কাটতে নেমে।

সবশেষ সোমবার দুপুরে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ‘সাদাপাথর’ থেকে জয় নামে এক পর্যটকের মরদেগ উদ্ধার করা হয়। এর দুই আগে শুক্রবার (২৫ আগস্ট) গোয়াইনঘাট উপজেলার জাফলং পর্যটন কেন্দ্রে রমিজ উদ্দিন নামে আরেক পর্যটকের মরদেহ উদ্ধার করা হয়।

সবশেষ দুর্ঘটনার ব্যাপারে জানা যায়, রাজধানী ঢাকার মগবাজার থেকে সোমবার দুপুরে ভোলাগঞ্জ সাদাপাথরে বেড়াতে আসেন চার বন্ধু। তাদের মধ্যে জয় গাইন (২৫) নামে একজন পানিতে ডুবে মারা যান।

জাফলংয়ে বন্যা-বৃষ্টির মৌসুমে নদীতে স্রোতের তীব্রতা বাড়ে, যা পর্যটকের জন্য অনেক সময় বিপদসংকুল হয়ে দাঁড়ায়।

কোম্পানীগঞ্জ থানার ওসি হিল্লোল রায় জানান, জয় সাদাপাথরে গোসল করতে নেমেছিলেন। এ সময় পানির তীব্র স্রোতে তিনি আর স্থির থাকতে পারেননি। মুহূর্তেই পানিতে তলিয়ে যান। প্রায় ১৫ মিনিট পর স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করেন। এরপর তাকে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে দায়িত্বরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।

এর আগে শুক্রবার সন্ধ্যার দিকে জাফলংয়ের নদী থেকে রমিজ উদ্দিন নামে ওই পর্যটকের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। ওইদিন দুপুরে তিনি জাফলংয়ের ডাউকি নদীর জিরো পয়েন্ট এলাকায় গোসল করতে নেমেছিলেন। কিন্তু স্রোতের টানে তলিয়ে যান। প্রায় ৪ ঘণ্টা সন্ধান চালিয়ে স্থানীয়দের সহায়তায় পুলিশ তার মরদেহ উদ্ধার করে।

সিলেটের পর্যটন কেন্দ্রগুলো বরাবরই পর্যটকদের কাছে বড় আকর্ষণ। সেগুলোর মধ্যে আগ্রহের শীর্ষে থাকে জাফলং, সাদাপাথর, বিছানাকান্দি ও লালাখাল। প্রতিটি পর্যটন কেন্দ্রই পানিকেন্দ্রিক। আর এসব স্পটে বেড়াতে এসে প্রায়শ পানিতে ডুবে মারা যাচ্ছেন পর্যটকরা। বর্ষা মৌসুমে নদীতে পানি ও স্রোতের তীব্রতা বেড়ে যায়। আর এ সময়টাতে ভিড় বাড়ে পর্যটকেরও। একইসঙ্গে পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে বাড়ছে দুর্ঘটনা, প্রাণহানি।

জাফলংয়ের পিয়াইন নদে ৬ জুলাই বাবার সঙ্গে গোসলে নেমে নিখোঁজ হয় ঢাকার রেসিডেনসিয়াল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণির ছাত্র আল ওয়াজ আরশ। ৮ জুলাই সকাল ৭টার দিকে ঘটনাস্থলের পার্শ্ববর্তী স্থানে তার মরদেহ ভেসে ওঠে।

এর আগে ১ জুলাই কোম্পানীগঞ্জের সাদাপাথর পর্যটন কেন্দ্রে আবদুস সালাম নামে এক তরুণ গোসল করতে নেমে নিখোঁজ হন। তার মরদেহ ভেসে ওঠে নিখোঁজ হওয়ার দুদিন পর।

সাদা পাথরে পানিতে পর্যটকের মাতামাতি থাকলেও কর্তৃপক্ষের নজরদারি ততোটা জোরদার নয়।

বার বার এমন অস্বাভাবিক মৃত্যুর জন্য সংশ্লিষ্টরা পর্যটকদের সচেতনতার অভাবকে দায়ী করেছেন। অপরদিকে পর্যটকদের অভিযোগ, স্থানীয় প্রশাসনের উদাসীনতায়ই পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে দুর্ঘটনায় প্রাণহানি বাড়ছে।

পর্যটন পুলিশ, থানা পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, সিলেটের সবচেয়ে আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র জাফলং। মেঘালয় পাঁহাড়ঘেষা জাফলংয়ের নদী থেকে অপরিকল্পিতভাবে পাথর ও বালু উত্তোলনের ফলে অনেক স্থান মৃত্যু ফাঁদে পরিণত হয়েছে। গত দুই দশকে জাফলংয়ে বেড়াতে এসে মারা গেছেন ৬০ জন পর্যটক।

অন্যদিকে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার সীমান্তঘেঁষা ধলাই নদের সাদা পাথর পর্যটকদের কাছে পরিচিতিই পেয়েছে ৫-৬ বছর আগে। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো হওয়ায় এখন প্রতিদিন বিপুলসংখ্যক পর্যটক আসেন সাদা পাথরে। তবে এই ৫/৬ বছরেই এখানে মারা গেছেন ১২ পর্যটক।

এ ছাড়া গোয়াইঘাট এলাকার পাথুরে নদীর আরেক পর্যটন কেন্দ্র বিছনাকান্দিতে এই সময়ে মারা গেছেন চারজন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্ষায় নদীর তীব্র স্রোত, চোরাবালি, নৌকাডুবি ও সাঁতার না জানার কারণে পানিতে ডুবে মারা যাচ্ছেন পর্যটকরা।

পর্যটকদের নিরাপত্তায় গাইডলাইন না থাকা এবং তাদের সচেতনতায় তেমন কোনো উদ্যোগ না থাকায় দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি বাড়ছে বলেও অভিযোগ উঠেছে।

সিলেট চেম্বার অফ কমার্সের সভাপতি তাহমিন আহমদ বলেন, ‘কয়েকটি সাইনবোর্ড টানানো ছাড়া সিলেটের পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে পর্যটকদের নিরাপত্তায় আর কোনো উদ্যোগ নেই। পর্যটন কেন্দ্রে টুরিস্ট পুলিশ বা স্বেচ্ছাসেবক নেই। ফলে পর্যটকরা ইচ্ছেমতো ঘোরাফেরা করেন। কেউ তাদের বাধা দেন না। তারাও বিপদের আশঙ্কার বিষয়টি সম্পর্কে আগেভাগে জানতে পারেন না।

সিলেটের সবচেয়ে পুরনো পর্যটন স্পট জাফলংয়ের নদীতে পর্যটকের বৃষ্টি বিলাস।

জানা গেছে, সিলেটের পর্যটন কেন্দ্রগুলো নিয়ন্ত্রণে একক কোনো কর্তৃপক্ষ নেই। বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড এবং বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্রের উন্নয়নসহ নানা দিক দেখাশোনা করে। তাদের পক্ষে সিলেটের পর্যটন কেন্দ্রগুলো পরিচালনা করছে পর্যটন উন্নয়ন কমিটি। এর সভাপতি জেলা প্রশাসক। এই কমিটিতে স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তারাও রয়েছেন।

উপজেলা প্রশাসন থেকে বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্রে কিছু স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ এবং লাইফ জ্যাকেটের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে পর্যটককের নিরপত্তার দিকটি মূলত পর্যটন পুলিশ দেখভাল করে। তবে তাদেরও রয়েছে লোকবল সংকট।

জাফলংয়ের ট্যুরিস্ট পুলিশের ওসি রতন শেখ বলেন, ‘ছুটির সময়ে এখানে পর্যটকের এতো ভিড় হয় যে ট্যুরিস্ট পুলিশের অল্প লোকবল দিয়ে তা সামলানো কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। তবু আমরা তাদের সচেতন করার চেষ্টা করি।

‘ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে সাইনবোর্ড টানানো আছে। মাইকিং করেও সতর্ক করা হয়। তবে অনেকে তা শুনতে চান না। পর্যটকদের অসচেতনতা ও নির্দেশনা না মানার কারণেই প্রাণহানির ঘটনাগুলো ঘটছে।’

জাফলং ও বিছানাকান্দি পর্যটন কেন্দ্রের অবস্থান গোয়াইনঘাট উপজেলায়। এই দুই স্থানে পর্যটকদের নিরাপত্তার বিষয়ে গোয়াইনঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তাহমিলুর রহমান বলেন, উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে একাধিকবার পর্যটন কেন্দ্রে সতর্কতামূলক বিলবোর্ড স্থাপন করা হয়েছে। তবে বন্যার পানিতে সেগুলো ভেসে গেছে।

তিনি বলেন, মৌখিকভাবেও পর্যটকদের সতর্ক থাকার পরামর্শ দেয়া হয়। কিন্তু ভ্রমণে আসা মানুষের মধ্যে এসব নিষেধাজ্ঞা শোনার প্রবণতা কম থাকে।

প্রবল স্রোতের পানিতে না নামা এবং পানিতে নামলে লাইফ জ্যাকেট পরার দিকে নজর রাখা প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।

সাদা পাথরে পর্যটকদের নিরাপত্তা প্রসঙ্গে কোম্পানীগঞ্জের ইউএনও লুসিকান্ত হাজং বলেন, ‘বর্ষা মৌসুমে হ্যান্ডমাইক নিয়ে দুজন স্বেচ্ছাসেবী সার্বক্ষণিক পর্যটন কেন্দ্রে থাকেন। তারা পর্যটকদের স্রোতের পানিতে না নামার আহ্বান জানান। নৌকার ঘাটে সাইনবোর্ড দিয়ে পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে ঝুঁকিপূর্ণভাবে পানিতে না নামতে নির্দেশনা দেয়া আছে। এরপরও পর্যটকরা এগুলো শুনতে চান না।

পর্যটকদের সতর্ক করার জন্য ঘাটে মাইক লাগানো এবং নৌকার টিকিটের পেছনে আরও কিছু নির্দেশনা দিয়ে প্রচার চালানোর উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি।

এই পোস্ট টি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরও সংবাদ
© All rights reserved © 2023 amadersomoy.net
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com