ঢাকা: সদ্য প্রণীত উপাত্ত সুরক্ষা আইনের (ডিপিএ) বিষয়ে বাংলাদেশের প্রশংসা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। একই সঙ্গে মার্কিন বাজার থেকে আমদানি করা তুলা ফের ফিউমিগেশন বা পুনঃপরীক্ষা না করার সরকারি সিদ্ধান্তে ইউএসটিআর সন্তুষ্টি জানিয়েছে। তবে এদেশে সংঘটিত শ্রমিক সংগঠক ও ট্রেড ইউনিয়নবিরোধী অপতৎপরতার বিষয়ে বাইডেন প্রশাসনের জোরালো নজর রাখার বিষয়টি বাংলাদেশকে স্পষ্ট করেছেন মার্কিন প্রতিনিধিরা। এ ছাড়া বিশ্বব্যাপী নকল তৈরি পোশাক রপ্তানির শীর্ষ পাঁচটি উৎসের তালিকায় বাংলাদেশের নাম থাকা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এবং এক্ষেত্রে পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপগুলো নিয়ে আলোচনা করেছে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশের চাহিদার প্রায় ১৪ শতাংশ তুলা আমদানি হয়। এই তুলায় তৈরি করা পোশাক ফের যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানির ক্ষেত্রে ডিউটি ফ্রি সুবিধার প্রস্তাব করেছে বাংলাদেশ। এর জবাবে মার্কিন প্রতিনিধিরা জানান, জিএসপির সংবেদনশীল তালিকায় নেই, এমন পণ্য রপ্তানিতে বাংলাদেশকে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেওয়ার বিষয়ে পর্যালোচনা করছে যুক্তরাষ্ট্র। একইভাবে তাদের কাছ থেকে আমদানিকৃত তুলায় তৈরি করা পোশাক তাদের দেশে রপ্তানির ক্ষেত্রে কী উপায়ে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেওয়া যায়, সেটি নিয়েও তারা কাজ করার কথা জানিয়েছেন। বলেছেন, এ বিষয়টি নিয়ে তারা তাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করবেন।
গতকাল বুধবার ঢাকায় অনুষ্ঠিত যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতা ফোরাম চুক্তির (টিকফা) সপ্তম বৈঠকের আলোচনায় এসব কথোপকথন উঠে আসে। এ ছাড়া বৈঠকে দুই দেশের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বেশ কিছু বিষয় গুরুত্ব পায়। উভয় দেশের প্রতিনিধিদল ২০২৪ সালে ওয়াশিংটন ডিসিতে অনুষ্ঠিতব্য পরবর্তী টিকফা কাউন্সিল মিটিংয়ের আগে দুদেশের গুরুত্বপূর্ণ দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যবিষয়ক সংলাপ চালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছে। বৈঠক সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
বৈঠকে যৌথভাবে সভাপতিত্ব করেন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ার ভারপ্রাপ্ত সহকারী বাণিজ্য প্রতিনিধি ব্রেন্ডান লিঞ্চ ও বাংলাদেশ সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব তপন কান্তি ঘোষ। সভায় অংশ নেওয়া উভয় দেশের প্রতিনিধিদলে বাণিজ্য, শ্রম, মেধা সম্পদ এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সংস্থার কর্মকর্তারা অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।
সূত্র মতে, বাংলাদেশের উপাত্ত সুরক্ষা আইনের নতুন খসড়ায় পূর্ববর্তী সংস্করণগুলোর উন্নতিগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে ফৌজদারি দণ্ড অপসারণ, ব্যক্তিগত উপাত্তের ক্ষেত্রে ডিপিএ প্রয়োগ সীমিত করা এবং আইনের প্রয়োগ বাংলাদেশের ভূখণ্ডে ব্যক্তিগত উপাত্ত প্রক্রিয়াকরণে যুক্ত সংস্থাগুলোতে সীমিত রাখা। বৈঠকে মার্কিন প্রতিনিধিরা এই উপাত্ত সুরক্ষা আইন বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের বিগত বছরজুড়ে সংলাপ ও আলাপ-আলোচনার প্রশংসা করেছে। উভয় পক্ষই ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষা ও ডিজিটাল অর্থনীতিতে আস্থা নিশ্চিত করার মাধ্যমে বাংলাদেশের ডিজিটাল খাতের সমৃদ্ধি অব্যাহত রাখার বিষয়ে তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষার নিশ্চয়তা দিয়েছে।
মার্কিন দূতাবাসের বিবৃতি: বৈঠক পরবর্তী এ বিষয়ক মার্কিন দূতাবাসের বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়—টিকফা কাউন্সিল বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সম্পর্ককে প্রভাবিত করে এমন বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বিশেষ করে শ্রম সংস্কার নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি বিনিয়োগ পরিবেশ ও ডিজিটাল বাণিজ্যকে প্রভাবিত করে এমন নীতি, মেধা সম্পদের সুরক্ষা ও আইনের প্রয়োগ এবং কৃষি খাতে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হয়।
বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে জানিয়েছে, শ্রমিকদের সংগঠন করার স্বাধীনতা ও যৌথ দরকষাকষি করতে পারাসহ তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় ব্যবসায়িক অংশীদারদের সঙ্গে কাজ করা বাইডেন-হ্যারিস প্রশাসনের অন্যতম অগ্রাধিকার। ফলে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় শ্রমিক ও ইউনিয়ন সংগঠকদের বিরুদ্ধে সহিংসতা মোকাবিলায় ওপর গুরুত্বারোপ করার পাশাপাশি ইউনিয়নবিরোধী বৈষম্য ও শ্রমিকদের বিরুদ্ধে অন্যান্য অন্যায্য চর্চা প্রতিরোধের জোর দেয় যুক্তরাষ্ট্র।
এ ছাড়া বাংলাদেশের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে (ইপিজেড) শ্রমিকদের সংগঠন করার স্বাধীনতা ও যৌথ দরকষাকষি করতে পারার অধিকার সম্প্রসারণে বাংলাদেশকে উৎসাহিত করেছে। একই সঙ্গে বাংলাদেশে ইউনিয়ন নিবন্ধন করার সময় শ্রমিকদের যে বাধার সম্মুখীন হতে হয়, তা মোকাবিলা করার জন্য বাংলাদেশে গৃহীত কিছু প্রচেষ্টার কথা উল্লেখ করে শ্রমিক ইউনিয়নের নিবন্ধন প্রক্রিয়া আইনি সময়সীমার মধ্যে সম্পন্ন করতে, নিবন্ধন প্রক্রিয়াকে সহজ ও নিরপেক্ষ করার ওপর জোর দেয় যুক্তরাষ্ট্র। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে শ্রম পরিদর্শন এবং আইন প্রয়োগ কার্যক্রমে আরও বেশি সম্পদ বরাদ্দের আহ্বান জানিয়েছে।
বিবৃতিতে আরও জানানো হয়, যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশ কৃষি ক্ষেত্রে জৈবপ্রযুক্তি ব্যবহারবিষয়ক সংলাপে পরস্পরকে সহযোগিতা করেছে এবং এই বছরে এ খাতে আরও গভীরভাবে যুক্ত হওয়ার লক্ষ্যে উভয় দেশ কাজ করছে। এ ছাড়া উভয় দেশই অর্থনীতিতে উদ্ভাবনমূলক মেধাস্বত্ব (আইপি) সুরক্ষা ও আইন প্রয়োগের গুরুত্ব স্বীকার করেছে। বাংলাদেশের কপিরাইট আইন সংশোধন, শিল্প নকশা আইন, পেটেন্ট বিল এবং প্রবিধান ও আইপিআর প্রয়োগ (আমদানি ও রপ্তানি) বিধিসহ মেধাস্বত্ব সংশ্লিষ্ট আইন ও বিধিমালা সংশোধনের চলমান প্রক্রিয়াগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র যুক্ত হওয়ার আগ্রহের কথা পুনর্ব্যক্ত করেছে।
বাংলাদেশ কী বলেছে: বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ। তিনি জানান, যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশের চাহিদার প্রায় ১৪ শতাংশ তুলা আমদানি হয়। এই তুলায় তৈরি পোশাক যাতে ডিউটি ফ্রি সুবিধা পায়—বৈঠকে সেকথা বলেছি। তারা নোট নিয়েছেন এবং বলেছেন, উচ্চ পর্যায়ে আলোচনা করবেন। এ ছাড়া আরও কিছু পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেওয়ার বিষয়ে পর্যালোচনা করছে—তারা আমাদের এমন তথ্য দিয়েছেন।
তিনি জানান, টিকফার বৈঠকে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সম্পর্ককে প্রভাবিত করে এমন বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বৈঠকে শ্রম সংস্কার নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি বিনিয়োগ পরিবেশ ও ডিজিটাল বাণিজ্যকে প্রভাবিত করে এমন নীতি, মেধা সম্পদের সুরক্ষা ও আইনের প্রয়োগ এবং কৃষি খাতে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার বিষয়গুলো গুরুত্ব পায়।
বাণিজ্য সচিব জানান, কারখানায় শ্রমিকের ট্রেড ইউনিয়ন করার ক্ষেত্রে বিদ্যমান বিধান আরও সহজ করার তাগিদ রয়েছে দেশটির পক্ষ থেকে। বর্তমানে যে কোনো কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন করতে হলে অন্তত ২০ শতাংশ শ্রমিকের লিখিত সম্মতির প্রয়োজন হয়। এটি কমানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্র অনুরোধ জানিয়েছে।